ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

পাঁচ বছরে দেওয়া হয়েছে সাড়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকা

রপ্তানিতে প্রণোদনা পাচ্ছে ৪৩ খাত

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ১৬ জুলাই ২০২৪

রপ্তানিতে প্রণোদনা পাচ্ছে ৪৩ খাত

রপ্তানির বিপরীতে দেশের ৪৩টি খাতকে নগদ সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা

রপ্তানির বিপরীতে দেশের ৪৩টি খাতকে নগদ সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এর মূল লক্ষ্য দেশের পণ্য রপ্তানি বাড়ানো এবং সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা ডলার এবং রিজার্ভ বৃদ্ধি পায় রপ্তানির মাধ্যমেই। বছরে এ খাতে সরকারের ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। গত পাঁচ অর্থবছরে মোট ৩৬ হাজার ৫১১ কোটি টাকার নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।

তবে রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা ও প্রণোদনার অর্থ প্রকৃত ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন কি না কিংবা প্রকৃত রপ্তানির বিপরীতে দেওয়া হচ্ছে কি না, সেই বিতর্ক এড়াতে এবার অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, রপ্তানির বিপরীতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রকৃতপক্ষে দেশে আসে, বাংলাদেশ ব্যাংক শুধুমাত্র সেই পরিমাণ অর্থ দেশের রপ্তানির পরিমাণ হিসাবে প্রকাশ করে থাকে। এ কারণে জিডিপি ও মাথাপিছু আয় কমে যাওয়ার যে আশঙ্কা করা হয়েছে তা সঠিক নয়। এ ছাড়া রপ্তানির বিপরীতে যে নগদ আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে তা সঠিক রয়েছে। 
জানা গেছে, রপ্তানির তথ্য নির্ভুল এবং প্রকৃত রপ্তানি কত হচ্ছে, সে লক্ষ্যে একটি ডাটা প্ল্যাটফর্ম চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ ধরনের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে ইতোমধ্যে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়য়ের সহযোগিতা চেয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এ ছাড়া সঠিক তথ্য নিরূপনে বাংলাদেশ ব্যাংক,  জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইপিবি সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করবে।

এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে রপ্তানির নির্ভুল তথ্য প্রকাশ করবে সরকার। শুধু তাই নয়, নির্ভুল তথ্য প্রদানের লক্ষ্যে ইপিবি কাজ শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থায়ন করা হলেও পরবর্তীতে এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক কিংবা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) কাছে অর্থ চাওয়া হবে। এর আগে এনবিআর অটোমেশনে অর্থায়ন করে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক।

মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি তথ্যের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা কর্তৃক উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে বর্তমানে একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। ফলে আশা করা যায়, এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর এবং ইপিবির প্রকাশিত রপ্তানি তথ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকবে না।
শুধু তাই নয়, রপ্তানির বিপরীতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রকৃতপক্ষে দেশে আসে, বাংলাদেশ ব্যাংক শুধুমাত্র সেই পরিমাণ অর্থ দেশের রপ্তানির পরিমাণ হিসাবে প্রকাশ করে থাকে। মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির হিসাব করার সময় বিবিএস সব সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের এ হিসাবকেই বিবেচনায় নেয়। ফলে রপ্তানি কমে যাওয়া এবং এর ফলে জিডিপি ও মাথাপিছু আয় কমে যাওয়ার যে আশঙ্কা করা হয়েছে, তা সঠিক নয়।  উল্লেখ্য, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের চলতি হিসাব এবং আর্থিক হিসাবের কিছু ক্ষেত্রে উপাত্তের পুনর্বিন্যাস হয়েছে। 
তবে এর ফলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সার্বিক ভারসাম্যে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ইতোমধ্যে সকলের অবগতির জন্য পুনর্বিন্যস্ত ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। রপ্তানির  ক্ষেত্রে প্রদত্ত নগদ আর্থিক প্রণোদনার পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক  প্রকাশিত প্রকৃত রপ্তানি আয় প্রাপ্তি এবং থার্ড পার্টি অডিটরের মাধ্যমে প্রকৃত ক্যাশ ইনসেন্টিভ নিরূপনের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

সুতরাং, সরকার কর্তৃক রপ্তানির বিপরীতে যে নগদ আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে, তা সঠিক রয়েছে। জানা গেছে, আর্থিক চাপ কমানো এবং এলডিসি উত্তরণ সামনে রেখে রপ্তানি খাতে প্রণোদনা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে রপ্তানিতে প্রণোদনা আগের মতো বহাল থাকলেও ধীরে ধীরে এ খাতে নগদ সহায়তা ও প্রণোদনা কমিয়ে আনার কৌশল গ্রহণ করেছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রপ্তানি খাত এবং কোন কোন খাত প্রণোদনা পাওয়ার যোগ্য সেই বিষয়টি চিহ্নিত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে থাকে।

আর অর্থ মন্ত্রণালয় রপ্তানির বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুকূলে অর্থ ছাড় করে। সাধারণত রপ্তানিকারকরা রপ্তানির বিপরীতে কি পরিমাণ টাকা দেশে আনছে, সেই হিসাবে কষে নগদ সহায়তা ও প্রণোদনা দিয়ে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রণোদনা ও নগদ সহায়তার এই অর্থ নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে বেশ কিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে কৃষিজাতপণ্য এবং গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিতে এ ধরনের কারসাজি বেশি হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। 
কয়েক বছর আগে কৃষিপণ্য হিসেবে সুপারি রপ্তানির নামে বিপুল পরিমাণ নগদ সহায়তার টাকা কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তুলে নেয়। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর থেকে রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদানে বেশ সতর্ক রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, ঢালাওভাবে সবাইকে দায়ী না করে যারা কারসাজি করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

তবে দেশের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিতে এখনই প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা তুলে দেওয়ার সময় হয়নি। এ প্রসঙ্গে পোশাক রপ্তানিকারক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রপ্তানি খাতের প্রণোদনা যাতে সঠিক ও প্রকৃত ব্যবসায়ীরা পান সেই উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য পোশাক রপ্তানি খাত চাপের মুখে রয়েছে। তাই এ খাতের প্রণোদনা এখনই কমানো ঠিক হবে না। আশা করব, রপ্তানির নির্ভুল তথ্য প্রকাশ করে উদ্যোক্তাদের সহায়তা ও প্রণোদনা দেওয়া হবে।  
উল্লেখ্য, নগদ সহায়তা সবচেয়ে বেশি পায় তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত। দেশি সুতা ব্যবহার করে উৎপাদিত তৈরি পোশাক নতুন বাজারে রপ্তানি করলে একটি কারখানা সর্বোচ্চ নয় দশমিক এক শতাংশ নগদ সহায়তা পেয়ে থাকে। এ ছাড়া পাটপণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ১৫ শতাংশ, পাটজাত পণ্যে সাত শতাংশ এবং পাট সুতায়  প্রণোদনা পাঁচ শতাংশ প্রদান করা হয়।

এ ছাড়া দেশের হালকা প্রকৌশল পণ্য, ওষুধের কাঁচামাল, বাইসাইকেল, হিমায়িত চিংড়ি, মোটরসাইকেল, ইলেক্ট্রনিকস, পেট বোতল ফ্লেক্স, জাহাজ, প্লাস্টিক পণ্য, হাতে তৈরি পণ্য যেমনÑ হোগলা, খড়, আখ বা নারিকেলের ছোবড়া, তৈরি পোশাক কারখানার ঝুট, গরু-মহিষের নাড়ি-ভুঁড়ি, শিং ও রগ, কাঁকড়া, কুঁচা, আগর, আতর ইত্যাদি পণ্য রপ্তানিতেও নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। রপ্তানির বিপরীতে গত পাঁচ অর্থবছরে মোট ৩৬ হাজার ৫১১ কোটি টাকার নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে ছয় হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আট হাজার ৬৮৯ কোটি, ২০২১-২২-এ আট হাজার ৭৮৫ কোটি, ২০২০-২১-এ ছয় হাজার ৬৪৬ কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছয় হাজার ৩৯১ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।

×