ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

স্মার্ট ভিলেজ গ্রামোন্নয়নের নতুন মডেল

অর্থনীতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:০২, ১৪ জুলাই ২০২৪

স্মার্ট ভিলেজ গ্রামোন্নয়নের নতুন মডেল

স্মার্ট ভিলেজ

‘স্মার্ট ভিলেজ’। দেশের প্রথম ‘স্মার্ট ভিলেজ’ হিজলী গ্রাম। জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে গ্রামটি। ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকু-ু উপজেলার কাপাশহাটিয়া ইউনিয়নের বাঁওড় পাড়ে এই হিজলী গ্রামের অবস্থান। গ্রামের প্রবেশপথে লাগানো হয়েছে সুন্দর একটি বোর্ড যেখানে লেখা আছে- স্বাগতম, স্মার্ট ভিলেজ হিজলী। ৩৩৪টি পরিবার রয়েছে হিজলী গ্রামে যার মধ্যে ৪৯৩ জন পুরুষ ও ৫১৯ জন নারীর বসবাস। এই গ্রামের ২৩৯জন পুরুষ এবং ২৬৮ জন নারী লিখতে পড়তে পারে। যে গ্রামের মাত্র ২ জন নারী ও ২ জন পুরুষ চাকরি করে। কৃষিকাজই গ্রামের মানুষের মূল পেশা। সব মিলিয়ে বলতে গেলে পিছিয়ে পড়া একটি গ্রাম হিজলী। 
উন্নয়নের কৌশল হিসেবে ধরা হয়েছে সংগঠন যেখানে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে গ্রামে গড়ে উঠেছে স্মার্ট মহিলা ক্লাব। সেখানে গ্রামের নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠার গল্প শুনে উৎসাহিত হয়। করা হয়েছে নির্যাতিত নারীদের প্রতিকারের ব্যবস্থা। ফলে এখন  গ্রামে নারী নির্যাতন ও বাল্যবিয়ে কমেছে। হিজলী গ্রাম এখন বাল্যবিয়েমুক্ত, অপরাধমুক্ত, আত্মহত্যামুক্ত, স্বনির্ভর, ডিজিটাল এবং পরিবেশবান্ধব। এখানে করা হয়েছে একটি স্মার্ট বৈঠকখানা। যেখানে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে প্রতি সপ্তাহে ১দিন করে গ্রামবাসীদের সমস্যা শোনা হয় এবং তার সমাধান দেওয়া হয়। 
নিকট অতীতের তথ্য থেকে জানা যায়, হিজলী গ্রাম এক সময় ছিল সন্ত্রাসীদের আখড়া, বসবাসরত মানুষের সঙ্গে উন্নয়নের স্রোতধারার সম্পৃক্ততা ছিল না। বর্তমান সরকারের ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়ায় এই ভীতি, কুসংস্কার এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদ আলোর মুখ দেখলেও এখানকার মানুষ  অপরাধপ্রবণ, শিক্ষাগ্রহণে অনাগ্রহী এবং প্রচলিত কৃষিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থার যাপিত জীবনে অভ্যস্ত।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হিজলী গ্রামটিকে স্মার্ট ভিলেজে বা মডেল করার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগকে বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রটোকল তৈরি করেছে। যা অনুসরণ করে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কাজ চলছে। যার মধ্যে রয়েছে গ্রামটিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে গ্রামবাসীদের বিশেষ করে নারীদের দক্ষতা বাড়ানো এবং অফলাইন-অনলাইন উভয়ক্ষেত্রেই বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ করা, ইন্টারনেট সংযোগ শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে কানেক্টিভিটি বৃদ্ধিকরণ, চাষযোগ্য জমি বিশেষ করে বাড়ির আঙিনার অনাবাদি জমিসহ শতভাগ জমিকে চাষের আওতায় এনে দেশের উৎপাদনশীলতাকে ত্বরান্বিতকরণ করা।

বাল্যবিয়ে বন্ধ করার মাধ্যমে মাতৃস্বাস্থ্যের কল্যাণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চিতকরণ। তাছাড়াও কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা বিশেষ করে যুবক শ্রেণির কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা, ঝরে পড়া, অটিষ্টিক এবং এতিম বাচ্চাসহ সব শিশুকে শিক্ষার মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা, সন্ত্রাস, নেশা এবং মোবাইল আসক্তি থেকে কিশোর কিশোরীদের দূরে রাখা, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারি অফিসসমূহকে সেবাগ্রহীতাদের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়া এবং রিনিউবল শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরণ করে স্মার্ট ভিলেজ ধারণা দেওয়া।

এ ছাড়াও এখানকার মানুষকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের স্বাদ দিতে একটি আধুনিক এবং নিজস্বতায় সমৃদ্ধ সমাজ ও প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ স্বপ্নের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের চিন্তা থেকেই এই হিজলী গ্রামকে স্মার্ট ভিলেজ করার উদ্যোগ। স্মার্ট ভিলেজ করার কারণে এই গ্রামে এখন ৩টি বাড়িতে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। জাপানি দাতা সংন্থা জাইকা প্রকল্পের সহায়তায় ৫টি সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন, গ্রামের নামে গ্রামের ৭০ শতক জমিতে পারিবারিক পুষ্টির বাগান স্থাপন করা হয়।  

যেখান থেকে নিয়মিত নিরাপদ বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন হচ্ছে এবং ২০টি বাড়িতে রান্নাঘরের আবর্জনা দিয়ে জৈব সার তৈরি করা হচ্ছে। মৃদু প্রতিবন্ধীদের মধ্যে থেকে ৩ জনকে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, গ্রামের শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য ৯ জনকে আউটসোর্সিং কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, স্মার্ট ভিলেজ হিজলীতে বাড়ানো হয়েছে ইন্টারনেট সুবিধা, গর্ভবতী মায়েদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং গ্রামের ২০২টি টিউবওয়েল আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছে।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে হিজলী গ্রামে স্মার্ট যুব ক্লাব স্থাপন করা হয়েছে। যাতে গ্রামের যুব সমাজকে মোবাইল ফোনের আসক্তি কমানো যায়। মাত্র ৬ মাসের প্রচেষ্টায় দেশের প্রত্যন্ত এই হিজলী গ্রাম এখন হয়ে উঠেছে প্রথম সারির স্মার্ট ভিলেজ। স্থানীয় কৃষি অফিস জানায়, হিজলী গ্রামকে স্মার্ট ভিলেজ করতে গ্রামের প্রায় ৪৫০টি উঠানের অনাবাদি জমির অর্ধেক অংশে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হয়েছে।

অবশিষ্ট সকল জমিও আবাদের আওতায় আসবে এবং বিষমুক্ত সবজি চাষাবাদ করা হবে। স্মার্ট ভিলেজের সুফল ইতোমধ্যে আসতে শুরু করেছে, এই উদ্যোগের আওতায় ৫০টিরও বেশি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং সেগুলোর বেশিরভাগই সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের নিয়মিত কার্যক্রমেরই অংশ। 
এরই মধ্যে সরকার স্মার্ট ডিজিটাল বাস্তবায়নে ২২১০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এতে বৈদেশিক ঋণ মিলবে ১ হাজার ৮৮২ কোটি টাকার, ২০২৭ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের ৩২টি পৌরসভার সাড়ে ৩২ লাখ মানুষের জীবনমান বদলে যাবে, আর এসব পৌরসভার সক্ষমতা আয়ও বাড়বে।  

প্রাথমিকভাবে ৩২টি পৌরসভা এবং দ্বিতীয় ধাপে ৫৩ পৌরসভা ও ৮টি সিটি করপোরেশনে এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সকল পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকেই এই প্রকল্পের অধীনে নেওয়া হবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে নাগরিকদের উন্নত জীবনমান নিশ্চিতের পাশাপাশি পৌরসভার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।  প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে আধুনিক ১৭৫টি ট্রাক ক্রয়, বর্জ্য পরিবহনে ২৭০টি ভ্যান ও ৮১০টি ট্রলি। তিন ধরনের গণশৌচাগার নির্মাণ করা হবে।

কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ৩০টি পরিশোধনাগার নির্মাণ করা হবে। যার মাধ্যমে বর্জ্য থেকে উৎপাদিত হবে বিদ্যুৎ ও সার। এসডিজি বাস্তবায়নে সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, এখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করে যার মধ্যে বস্তিবাসী সাড়ে ৩ শতাংশ।  এখানে উল্লেখ্য যে, স্মার্ট সিটির ধারণা নিয়ে ইউরোপের দেশগুলো তাদের শহরের ব্যবস্থাপনা সাজিয়েছে।

সেখানে অবকাঠামো, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশনসহ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, উন্নত ধ্যান-ধারণা যুক্ত হওয়ায় এটি একটি ব্যাপক কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশেও  এটার প্রয়োগ সম্ভব। সেক্ষেত্রে শহরগুলোর সক্ষমতা ও সম্ভাবনা বিবেচনায় নিতে বলেন এ নগর পরিকল্পনাবিদ। দক্ষ জনবল বা স্মার্ট পিপল ছাড়া শুধু প্রকল্পের মাধ্যমে সফলতা আসবে না। আর পয়ঃবর্জ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়াচ্ছে, আর এসব সেবার মান নিশ্চিত করতে মেরিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে একটি সেল গঠন করা হয়েছে।

সংস্থাটির এক সমীক্ষার মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নে এ প্রকল্পটি সাজানো হয়েছে। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এসব পৌরসভার সাড়ে ৩২ লাখ লোকের জীবনমান বদলে যাবে। উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। যার মাধ্যমে এসব এলাকার ৭০ শতাংশ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় আসবে। আর একই হারে পয়ঃনিষ্কাশনের আওতা বাড়বে। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ও ব্যবসার সুযোগ তৈরি হবে।

সর্বোপরি এসব পৌরসভার আয় ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। আর অনিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশন এবং আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থার জন্য রোগ-বালাই কমে গিয়ে মানুষের চিকিৎসার ব্যয় কমে আসবে। শহরের বর্জ্য থেকে প্রথমত সার তৈরি করা হবে। তাছাড়া এসব বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ করে ছাই তৈরি করা হবে যা বিভিন্ন সিমেন্ট কারখানাসহ রাসায়নিক কারখানায় ব্যবহার করা যাবে, আর এসব বর্জ্য থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি চালিত হবে। 
অর্থনীতি প্রতিবেদক

×