অর্থনৈতিক নানা চ্যালেঞ্জ নিয়েই শুরু হলো নতুন অর্থবছর
অর্থনৈতিক নানা চ্যালেঞ্জ নিয়েই শুরু হলো নতুন অর্থবছর। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, বিনিয়োগ ও রাজস্ব আয় নিয়ে অর্থনীতিতে ছিল এক ধরনের চাপ। বছর শেষে রপ্তানি আয় নিয়েও শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নানা ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়েই নতুন অর্থবছরের (২০২৪-২৫) হিসেব কষা শুরু হয়ে গেল। বিদায়ী ও নতুন অর্থবছরের সমসাময়িক বিষয় নিয়েই আজকের লেখা। লিখেছেন- জলি রহমান
যখনই দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিক বাড়তে থাকে তখনই একশ্রেণির মানুষের মুখে মূল্যস্ফীতি শব্দটা খুব শোনা গেলেও গরিব লোকেরা জানেই না মূল্যস্ফীতি কি? তারা শুধু বোঝে ক্ষুদার জ্বালা। সারাদিন পরিশ্রম করেও বাচ্চাদের মুখে তিনবেলা ভাত না দিতে পারার যন্ত্রণা। সার্বিক মূল্যস্ফীতির তুলনায় বেশি বাড়ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি।
ক্রমান্বয়ে পুষ্টি ও মেধাহীন সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি নিয়ে আমরা উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন বুনছি। মূল্যস্ফীতি অদৃশ্য এক করের ন্যায় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নি¤œ ও মধ্যবিত্তের কাছে। পেটের দায়ে খেতে হবে, আর বেশি মূল্যেই পণ্য কিনতে হবে। বিদায়ী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ছিল সরকারের। অবশ্য বাজেট ঘোষণার সময় তা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
পুরো বছরে কোনো মাসেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। আর বারো মাসের মধ্যে সাত মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে, কমছে প্রকৃত আয়। দেশের নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা ভালো নেই, প্রতিনিয়ত নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। বাজেটের মূল লক্ষ্যই দেশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা।
ডলার সংকট
গত অর্থবছর জুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ডলার সংকট। গত দুই বছর ধরেই ডলার সংকট প্রতিনিয়ত ঘনীভূত হচ্ছে। ডলারের অভাবে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনতে না পারায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। দেশের শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগেও স্থবিরতা লক্ষণীয়। ডলারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় ভালো উদ্যোক্তারাও খেলাপি হয়ে পড়ছেন। কেননা ব্যাংক ঋণের সুদহার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
এতে সরকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও ব্যাংকের আয় কমছে। অন্যদিকে আমদানি কমিয়ে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা মূল্যস্ফীতিকে করেছে চাঙ্গা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে এই হার ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে আসে। অর্থাৎ শিল্পের উৎপাদন কমছে ধারাবাহিকভাবে।
অর্থনীতির প্রাণ তৈরি পোশাক খাতও আজ হুমকির মুখে। নতুন অর্থবছরে দেশের ডলার সরবরাহ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতনের পর এখন ১১০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। এই ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলেই আশা করা যায়।
রপ্তানি আয়ে হতাশা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলের প্রকৃত রপ্তানি আয় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার কম। অর্থনীতিবিদরা এটিকে সম্প্রতি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় ধাক্কা বলে অভিহিত করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রপ্তানি তথ্যের গরমিলের বড় অঙ্ক সামনে আনার পর সরকার তথ্য গণনা পদ্ধতি সংশোধনের উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। যেন একই ধরনের গরমিলের আবার পুনরাবৃত্তি না হয়।
সাম্প্রতিক রপ্তানি তথ্যে ধাক্কার পর ডাটা গভর্নেন্স বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এতে মোট ও নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মতো আরও অনেক পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রপ্তানি পরিসংখ্যানের সঠিক তথ্য সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পরিসংখ্যানগত ভুল অনেক অর্থনৈতিক সূচককে বিপর্যস্ত করতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) তার মধ্যে অন্যতম। এই তথ্যগত পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না খোদ অর্থনীতিবিদরাও।
অন্যদিকে কর্তৃপক্ষও প্রায় নীরব। আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে তথ্যের এই ভুলকে ভুল হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন। অর্থনীতি চক্রাকারে আবর্তিত হয়। রপ্তানি আয় কমে যাওয়া মানে কমবে জিডিপির আকার ও মাথাপিছু আয়। বাড়বে বাণিজ্য ঘাটতি। চলতি অর্থবছরে এসব পরিসংখ্যানের সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে বলেই আশা করছি।
জনসম্পদে পরিণত হোক জনসংখ্যা
জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন অত্যন্ত জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ১১৯ জনের বসবাস। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে শুরু করে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব সমস্যা ভবিষ্যতে আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। দেশে প্রতি বছর প্রায় দুই মিলিয়ন তরুণ কর্মজীবনে প্রবেশ করলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।
বিআইডিএসের তথ্য মতে, ৬৬ শতাংশ স্নাতক সম্পন্নকারী তরুণ কর্মহীন। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, টেকনিক্যাল খাতে দক্ষ মানব সম্পদের অপ্রতুলতা প্রায় ৬৯ শতাংশ। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে দেশের মানুষকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষিত এবং দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ১০ কোটি মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে যাদের অধিকাংশ কর্মক্ষম। এই বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে যদি দক্ষ করে তোলা যায়, তা হলে দেশের সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবিলা করা সহজ হবে। তাই নতুন অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারিভাবে অদক্ষ জনসংখ্যাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদে পরিণত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সরকারকে আরও কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে।
বিবিএস-এর হিসাবে, দেশে এখন অতিদারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং সার্বিক দারিদ্র ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। আগামী ২০৩১ সালের মধ্যে দেশে অতিদারিদ্র্যের হার কমিয়ে ৩ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। তবে এ লক্ষ্য পূরণে প্রথমেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতা ভেঙে বাড়াতে হবে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ। এছাড়াও রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য এনে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে সরকার সদাতৎপর থাকবে বলেই প্রত্যাশা।