.
হঠাৎ করেই অস্থির পেঁয়াজের বাজার। সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে ৪৫-৫০ টাকা দাম বেড়ে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০ টাকায়। এবার জুলাই মাসেই পেঁয়াজের বাজারে ‘অক্টোবর আতঙ্ক’ শুরু হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, দাম বাড়ার কারণে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বাজারে এ পণ্যটির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। পেঁয়াজের মজুত বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে, প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরাও ভালো মুনাফার আশায় পেঁয়াজ হাতছাড়া না করে ধরে রাখার কৌশল নিয়েছেন। আবার ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেশি হওয়ার কারণে আমদানি হচ্ছে কম। এ অবস্থায় মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ ও বাজারে দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি করা না গেলে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে পেঁয়াজের দাম।
এদিকে, সদ্য শুরু হওয়া চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে পেঁয়াজসহ অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি পণ্য আমদানিতে উৎসে কর ১ শতাংশ কমানো হয়েছে। দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রেখেছে সরকার। এর পাশাপাশি সরকারি অর্থায়নে পেঁয়াজ সংরক্ষণে ফরিদপুর, পাবনাসহ উৎপাদনকারী জেলাগুলোতে ‘মডেল’ ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে গত কয়েক বছরের তুলনায় দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। একই সঙ্গে ভারত থেকে আমদানি অব্যাহত রয়েছে। ফলে নিত্যপণ্যের বাজারে এ নিত্যপণ্যটির সংকট হওয়ার কথা নয়। এ অবস্থায় হঠাৎ করে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি রহস্যজনক বলে মনে করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পেঁয়াজের দাম, সরবরাহ এবং আমদানি পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করছে মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত পূর্বাভাস সেল। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু সম্প্রতি পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, সরবরাহ ও আমদানি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
আগামী সপ্তাহে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিতব্য ওই বৈঠকের পরই পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক করার বিষয়ে সরকারি ঘোষণা আসতে পারে। এ ছাড়া আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি কঠোর মনিটরিংয়ের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি বা কমার বিষয়টির খোঁজ খবর নেওয়া হয়। এ ছাড়া সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা-টিসিবি এবং কৃষি সম্প্রসরাণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত রিপোর্ট করা হয়। এ অবস্থায় পেঁয়াজের দাম বাড়ার বিষয়টি সরকারের নজরদারির মধ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, সাধারণত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের দিকে পেঁয়াজের সংকট তৈরি হয়। এবার দু’মাস আগেই পেঁয়াজের দাম বাড়ার বিষয়টি রহস্যজনক। এক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দায়ী কি না সেই বিষয়টি তদারকি করা হচ্ছে।
সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির তথ্য মতে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এ বছর পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৫৬ শতাংশ, যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। এবার দু’মাস আগেই বাজারে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের তৎপরতা বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে, পেঁয়াজের বাজার তদারকিতে মাঠে নামবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার মনিটরিং টিম। শীঘ্রই অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পেঁয়াজের আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে এ পণ্যটির সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এর আগে গত বছর পেঁয়াজের প্রধান উৎস প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে বিকল্প দেশ চীন, মিসর, তুরস্ক, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডসহ ১১টি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ভারতে এখন পেঁয়াজের দাম অন্য বছরের তুলনায় বেশি। এ কারণে ভারত থেকে আমদানির পাশাপাশি বিকল্প উৎস থেকে এ পণ্যটি সংগ্রহ করা যায় কি না সেই বিষয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এছাড়া নিয়মিত বাজার মনিটরিং এবং অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তাদের জন্য নতুন অস্বস্তি ডেকে এনেছে। পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ সংকট, আমদানি ও ফলন কমে যাওয়ার কারণে দেশে এ পণ্যটির দাম বাড়ছে। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পাইকারি বাজারে পণ্যটির সরবরাহ আছে। কিন্তু দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এ কারণে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১২৫-১৩০ টাকা পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে খিলগাঁও গোরান বাজারের ব্যবসায়ী ও ভাই ভাই স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. মোস্তফা হায়দার টিটু বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজের দাম বাড়তি। সরবরাহ বাড়িয়ে দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া না হলে অতীতের মতো নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে এ পণ্যটির দাম।
এদিকে, যেভাবে দ্রুত দাম বাড়ছে তাতে সাধারণ ভোক্তাদের অস্বস্তি বাড়ছে। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধ না হলে অতীতের মতো এবার ৩০০ টাকা পেঁয়াজের দাম উঠতে পারে। এ জন্য ‘প্যানিক’ তৈরি হওয়ার আগে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণ করা উচিত। প্রয়োজনে বিশ্বের যেখানে পেঁয়াজের দাম কম সেখান থেকে আমদানি করতে হবে। এ ছাড়া আমদানি বাড়ানো গেলে অনেকেই নিজের মজুতকৃত পেঁয়াজ বাজারে ছাড়তে শুরু করবেন। অতি মুনাফার আশায় পেঁয়াজ মজুত করে রাখা হয়েছে। এ জন্য অভিযান জোরদার করারও তাগিদ দিয়েছেন কেউ কেউ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি, এ বছর দেশে ৩৪ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে, যা চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আরও ছয় থেকে সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। কারণ দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণ সুবিধার অভাব আছে, এতে উৎপাদিত পেঁয়াজের কিছু অংশ নষ্ট হয়। তবে পেঁয়াজ বিক্রির অন্যতম কেন্দ্র ঢাকার শ্যামবাজার এলাকার ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, আমদানি কম এবং এ বছর উৎপাদনও কিছুটা কম হয়েছে।
শ্যামবাজার পেঁয়াজ আড়ততদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পাইকারি বিক্রেতা মোহাম্মদ আবদুল মাজেদ বলেন, বাজারে দেশি পেঁয়াজের সঙ্কট রয়েছে। এছাড়া ভারত, পাকিস্তান, তুরস্কসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি কম হওয়ায় পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ পেঁয়াজের চাহিদা থাকে, তার সিংহভাগই দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ হলেও ঘাটতি পূরণ করা হয় আমদানি করে। যার অধিকাংশই আসে ভারত থেকে। যেহেতু ভারত রপ্তানিমূল্য বাড়িয়ে রেখেছে, সে কারণে মিয়ানমার, মিসর, তুরস্ক ও চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। ভারতে পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য (এমইপি) এখন টনপ্রতি ৫৫০ মার্কিন ডলার। যা আমদানি করতে আরও কিছু শুল্ক-কর রয়েছে। এতে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে কেজি প্রতি খরচ পড়ছে বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৯০ টাকা। এতে করে আমদানি কম হচ্ছে।