ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০২ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১

আম্র কথন

এস এম মুকুল

প্রকাশিত: ০০:৫৫, ৩০ জুন ২০২৪

আম্র কথন

প্রতিবছরই মধু মাসের মৌসুমি ফলের বাজারে রাজত্ব

দেশী ফলের মাঝে শীর্ষ জনপ্রিয় এই ফলটি জাতীয় ফলের খেতাব না পেলেও কিচ্ছু যায় আসে না। কেননা, আমের জনপ্রিয়তা সবসময়ই তুঙ্গে। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই আমের ফলন হলেও রাজশাহীর আমের আছে অনেক সুনাম।  আমের  মৌসুমে এখানে ৮ থেকে ১০ লাখ লোক আমগাছ পরিচর্যা, বাগান পরিষ্কার রাখা, আম সংগ্রহ, বিক্রি ও পরিবহন ইত্যাদি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। সেখানকার নারী থেকে শিশুরাও আমকেন্দ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত।

পুরো রাজশাহী অঞ্চলে আমকে কেন্দ্র করে আমবাগান, বাগান লিজদার, বাগান প্রহরী, বাগান পরিচর্যাকারী, বহনকারী, আড়তদার, অস্থায়ী  হোটেল ব্যবসায়ী, ঝরা আমের কারবারিÑ এসব নানা কর্মের চাঞ্চল্য লক্ষণীয়। আম কেটে শুকিয়ে তৈরি করা আমচুর কিংবা আমসত্ত্বের আছে কোটি টাকার বাজার। আমের আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক- এস এম মুকুল  

আমের রাজত্ব
প্রতিবছরই মধু মাসের মৌসুমি ফলের বাজারে রাজত্ব করা ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম আম, জাম, লিচু ও কাঁঠাল। এদের মধ্যে উৎপাদন, বাজার মূল্য, জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে আম। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল হলেও আমের জনপ্রিয়তা বেশি। রাজকীয় ফল আম পুষ্টিগুণের পাশাপাশি লাভজনক অর্থকরী ফসল হিসেবেও ভূমিকা রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতে। আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরো অর্থনীতিই আমকে ঘিরে। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকে কেন্দ্র করে বছরে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জেই বিক্রি হয় প্রায় ছয় কোটি টাকার দুই লাখ আমের চারা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আট’শ জাতের আম চাষের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১১টি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ২১টি আমের জাত উদ্ভাবন করেছেন। উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে আম্রপালি সবচেয়ে জনপ্রিয়। 

বিশ্বে বাংলাদেশের আমের সুনাম 
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশে যখন আম পাকে, তখন বিশ্ববাজারে আর কোনো আম পাওয়া যায় না। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে আম চাষ হয় প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে। আমের উৎপাদন কমবেশি ১৪ লাখ টন। উৎপাদিত আমের বাজারমূল্য প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিযোগ্য আমের পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার টন। আশা জাগানিয়া খবরটি হলো- বাংলাদেশের ল্যাংড়া ও আম্রপলি আম যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের ক্রেতারা বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু ফল হিসেবে বাংলাদেশের আমকে বেশ পছন্দ করছে।

গুণে ও মানে অতুলনীয় হওয়ায় বিশ্ববাজারে দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশের আমের চাহিদা। রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট কোম্পানি বাংলাদেশের আম রপ্তানি করবে জার্মান, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে উৎপাদন করতে পারলে বছরে এক হাজার টন আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে। আম উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আম হতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য।


বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ 
বাংলাদেশের সব অঞ্চলে আমের চাষ হলেও উন্নত জাতের আম হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ ও দিনাজপুরে। আম উৎপাদনে দেশে দ্বিতীয় অবস্থানে সাতক্ষীরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থিত আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, দেশের ২২টি জেলায় এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমের চাষ হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে, সব জেলায় আমের চাষ বাড়াতে বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনে গবেষণা হচ্ছে। এমনকি উপকূলীয় লবণাক্ত ভূমিতেও এখন মিষ্টি আমের চাষ শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি আমগাছ রয়েছে। বাণিজ্যিক চাষে আগ্রহীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে আমগাছ ও বাগানের সংখ্যা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে প্রতি বছর নতুন করে আট হাজার হেক্টর জমি আম চাষের আওতায় আসছে। ফলে বছর প্রতি আম উৎপাদন বাড়ছে ৫০ হাজার টন। 
ফ্রুট ড্রিংকস ও জুসশিল্পে সম্ভাবনা 
কৃষিপণ্য আমকে শিল্পপণ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে আমশিল্প গড়ে তোলার সব রকম উপকরণই বাংলাদেশে রয়েছে। আম থেকে তৈরি হতে পারে আমের রস, মোরব্বা, স্কোয়াশ, জেলি, পাল্প, টফি, মধু, আমসত্ত্ব, বরফি, আচার, জ্যাম, পাউডার। আম ফলের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে জুসশিল্প। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমের জুস এখন রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। দেশের অভ্যন্তরে ও রপ্তানি মিলে জুসের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার। জুসের বাজারে প্রাণ, আকিজ, একমি, সজীব, ট্রান্সকম ও পারটেক্স গ্রুপ এগিয়ে আছে।  

বাংলাদেশের জুস রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ-আরব আমিরাত, আবুধাবি, দুবাই, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান ছাড়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ ইতালি, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের বাজারে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারটি হচ্ছে, দেশে উৎপাদিত এবং বাজারজাতকৃত জুস ও ফ্রুট ড্রিংকসে মেশানো হচ্ছে ভেজাল। আর দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ব্যাপক উৎপাদন ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার পরও দেশে সঠিক সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার ফলে আম আহরণের পর প্রায় ৩৩ শতাংশ আম নষ্ট হয়। এই পরিমাণ আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি আয় হওয়ারই কথা। 
ডায়াবেটিস আম 
রসালো, রং, রস, আঁশহীন আকর্ষণীয় এ অভিনব জাতটি উদ্ভাবনে এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক ও উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. আবদুর রহিম। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে গবেষণা করে তিনি উদ্ভাবন করেছেন ডায়াবেটিক বা বাউআম-৩। এ আমে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কম বিধায়, তা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বেশ উপকারী। এরই মধ্যে এ জাতের আমের চারা সারা দেশে সরবরাহ শুরু করেছে বাকৃবি জার্মপ্লাজম সেন্টার।

ডায়াবেটিক আম সম্পর্কে উদ্ভাবক ড. রহিম বলেন, এ জাতের আম নিয়মিত ফল ধারণকারী ও বামন প্রকৃতির জাত। গাছে প্রতি বছরই প্রধানত দুইবার ফুল ও ফল ধরে থাকে। জুন মাসের শেষের দিকে এ জাতের পাকা ফল পাওয়া যায়। ফুল আসা থেকে ফল পরিপক্ব হতে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ মাস সময় লাগে। ফলের আকার মাঝারি ও লম্বাটে প্রকৃতির। ফলে রসের পরিমাণ কম, কিন্তু আঁশের পরিমাণ বেশি। 
চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম জিআই পণ্য
দেশের তৃতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম। উল্লেখ্য, দেশের প্রথম ঐতিহ্যবাহী পণ্য হিসেবে জামদানিকে জিআই নিবন্ধন পায়। পরবর্তীতে জাতীয় মাছ ইলিশ জিআই সনদ লাভ করে। খিরসাপাত আম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অত্যন্ত সুস্বাদু ফল। দেশের উৎপাদিত আমের শতকরা ২০-২৫ ভাগ আমই খিরসাপাত জাতের। এ জাতের আম প্রতিবছর রফতানি হওয়া আমের তালিকায়ও শীর্ষে। খিরসাপাত আমের বিপুল সম্ভাবনা বিবেচনা করে এর জিআই নিবন্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

×