ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০২ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১

অর্থনীতির সংস্কার প্রসঙ্গ ভর্তুকি

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ০০:৫২, ৩০ জুন ২০২৪

অর্থনীতির সংস্কার প্রসঙ্গ ভর্তুকি

সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক

আইএমএফের পরামর্শে ১৯৮৯ সাল থেকে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চসীমা ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে শেষ পর্যন্ত তা আর ধরে রাখতে পারেনি। এরপর আইএমএফ বেশকিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।

সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং গত বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।

সর্বশেষ গত সোমবার (২৪ জুন) আইএমএফের পর্ষদে তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার ছাড়ের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের জন্য ২২৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার ছাড় করেছে। 
আইএমএফ ঋণ অবমুক্তির আগে যে সকল শর্ত অরোপ করে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো আর্থিক খাতের স্থায়িত্ব, ব্যাংক খাতের সংস্কার, তারল্য ব্যবস্থাপনা, ডলারের বাজারভিত্তিক লেনদেন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন, ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি, সুদের হার ও মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন প্রভৃতি।

এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে ভর্তুকি পরিশোধের পরিবর্তে বন্ড ইস্যু না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য ঋণের তৃতীয় কিস্তি অনুমোদনের পর সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আর্থিক বিচক্ষণতার সুরক্ষায় নতুন করে বকেয়া এড়ানোর পাশাপাশি এরই মধ্যে পুঞ্জীভূত হওয়া বকেয়া পরিশোধ করা গুরুত্বপূর্ণ। স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদক (আইপিপি) ও সার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বাড়তি ভর্তুকি দাবির কারণে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে জিডিপির ১ শতাংশ পরিমাণ বকেয়া জমেছে।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আইএমএফের কাছে নতুন করে বকেয়া পুঞ্জীভূত হওয়া এড়ানোর পাশাপাশি জমে থাকা বকেয়া আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বাজেট থেকে পরিশোধ করার পরিকল্পনা করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিদ্যুৎ ও সার কোম্পানিগুলোর পাওনা পরিশোধে ভর্তুকির পরিবর্তে বিদ্যমান বাজারদরের চেয়ে কম সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষ বন্ড ইস্যু বন্ধ করার কথাও বলেছে আইএমএফ। সংস্থাটির তথ্যানুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ সরকার ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করেছে।

উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে পড়ে যাওয়া আর্থিক হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বিনিময় হারের ওপর চাপ বেড়েছে। যা সংস্কারের গতিকে পুনরুজ্জীবিত করার তাগিদ জানাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাহ্যিক ও মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ তীব্র হলে গ্রহণ করা নীতিগুলোকে আরও কঠোর করতে প্রস্তুত থাকার সুপারিশও প্রতিবেদনে দিয়েছে আইএমএফ। মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতি প্রসঙ্গে সুপারিশে বলা হয়েছে, বাড়ন্ত মূল্যস্ফীতির জন্য মুদ্রানীতি কঠোর করা প্রয়োজন। 
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ক্রলিং পেগের কার্যকারিতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় গত বছরের ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশকে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ও সংস্কার করতে বলেছিল আইএমএফ। সেগুলোর মধ্যে একটি বাদে বাকি সবক’টিই পূরণ হয়েছে। শুধু নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এ সময়ে ১৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ।

এ বছরের মার্চ শেষে ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে পারেনি। বাংলাদেশের অনুরোধে আইএমএফ এ বছরের জুন শেষে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ১৪ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে এনেছে। সংস্থাটির তথ্যানুসারে এ বছরের এপ্রিল শেষে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ছিল ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।

সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, এ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ১৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ও ডিসেম্বর শেষে ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন এবং আগামী বছরের মার্চ শেষে ১৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন এবং জুন শেষে ১৯ দশমিক ৪৭ বিলিয়র ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হবে।
নগদ অর্থের সংকটের কারণে বিদ্যুৎ ও সার খাতে ভর্তুকি বাবদ বিপুল অংকের অর্থ বকেয়া হয়ে পড়ে সরকারের। এ ভর্তুকি পরিশোধে আলোচ্য দুই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা পরিশোধে অর্থায়নকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনুকূলে বিশেষ বন্ড ইস্যু করে সরকার সেখানেই আইএমএফের আপত্তি। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নয়া বাজেটে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা, যা গত বছরের মূল বাজেট থেকে ২৭২ কোটি টাকা কম।

জার্মানি থেকে প্রকাশিত গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৪ বাংলাদেশকে বিশ্বের প্রথম সারির খাদ্যনিরাপত্তাহীন ১০টি দেশের মধ্যে অষ্টম স্থানে রেখেছে। বিবিএসের তথ্যানুসারে দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার অভাব রয়েছে। এক যুগ ধরে জাতীয় বাজেটের আকার দ্রুত বাড়ছে, সে তুলনায় কৃষি খাতে বাজেট বাড়ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের দেওয়া ২০১১-১২ অর্থবছরের মোট বাজেটে কৃষি বাজেটের হিস্যা ছিল ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

আর এই ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৯০ শতাংশে। একইভাবে কৃষি ভর্তুকির হিস্যা নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৪ থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশে। এটার দায় কি আইএমএফের ওপরে চাপানো হবে? আইএমএফ অর্থ ছাড় করার শর্ত হিসেবে বাজেট ভর্তুকি কমানোর চাপ দিলে শুধু কৃষি খাতের কথা মনে হয়? বাজেটে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য মোট ভর্তুকি বরাদ্দ ১ লাখ ৮ হাজার ২৪০ কোটি টাকা, এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাত পাবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩৭ শতাংশ। উল্লেখ্য, দাতা সংস্থাগুলোর বারংবার চাপ সত্ত্বেও গত দুই অর্থবছরেই বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা।

গত বছর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ভর্তুকির বেশির ভাগ অর্থ বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ মেটাতে ব্যয় করা হয়। এই খাতের বিশেষজ্ঞরা গত কয়েক বছর ধরেই বলছেন, বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ ও আমদানি শুল্কের ছাড় নিয়ে রয়েছে ভীষণ অস্বচ্ছতা ও স্বজনপ্রীতি এবং এই খাতের ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন যাতে না তোলা যায় সেজন্য দায়মুক্তি আইন করে জবাবদিহিতা বন্ধ রাখা হয়েছে। 
গত বছরের জানুয়ারি থেকে সরকার বেশ কয়েকবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও বাজেটে এই বড় অঙ্কের ভর্তুকি রাখায় এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তাহলে কৃষি খাতের ভর্তুকি দিতে এত কার্পণ্য কেন? এই ভর্তুকির অর্থ তো তবু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতেই থাকছে, সরাসরি কৃষি উপকরণের দাম কমাতে সাহায্য করছে। জ্বালানি খাতের ভর্তুকি বাদ দিয়ে অথবা কমিয়ে একই পরিমাণ বরাদ্দ দিলে কৃষি খাতে যা যা করার জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা যেত।
দেশের ৪৫ শতাংশ কৃষিজীবী মানুষের জন্য বরাদ্দ মাত্র মোট বাজেটের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অপ্রতুল। অর্থনীতিবিদরা মনে করছে, বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে টার্গেট গ্রুপ ঠিক করে ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে যার জন্য কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদিত পন্যের ন্যায্য দাম কৃষককে নিশ্চিত করতে পারলে এ খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।

×