![চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/eco-1-2406291849.jpg)
চামড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য
চামড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য। পোশাক শিল্পের পরই চামড়ার স্থান। আশির দশক থেকেই এই শিল্পের নানা সমস্যার কথা বলা হলেও একে একটি সুষ্ঠু কাঠামোর মধ্যে আনা যায়নি। পোশাক খাতের প্রতি নজর বেশি থাকায় তা অনেকদূর এগিয়েছে। দেশের শিল্প বিকাশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বড় আকারে ভূমিকা পালন করতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে চামড়া শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি পণ্য। দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক গুনমানের অভাবে এ শিল্পের বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে। তবে আশার কথা হলো- শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক দেশের চামড়া শিল্প ব্যবস্থাপনায় ‘বাংলাদেশ চামড়া শিল্প ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আইন ২০২৪’ শীর্ষক যে খসড়া আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন এ শিল্পের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে আশা করছি ।
চামড়ার ওপর ভর করে দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৩০ টিরও বেশি ট্যানারি। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কম। কোরবানির সময় পানির চেয়েও কম দামে চামড়া বিক্রি হয়। আবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার কারণে এবং উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় অতীতে চামড়া নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে, মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের খবর খুবই উদ্বেগজনক।
চামড়ার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ খাত দেখার কি কেউ নেই! প্রতিবেশী ভারতে বাংলাদেশী চামড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, দামও বেশি। কারণ, বাংলাদেশী চামড়ার মান ভালো। সুযোগ নিয়ে কিছু পাচারকারী ভারতে প্রতিবছর চামড়া পাচার করে যাচ্ছে। দেশীয় বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের কারখানা প্রতিষ্ঠা, চাহিদা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করলে চামড়া পাচার রোধ করা সম্ভব। এই সঙ্কট উত্তরণের জন্য সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
ঢাকার হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্প নগরী স্থানান্তরের জন্য ২০০৩ সালে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। সে অনুযায়ী ২০০ একর জমি নিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় গড়ে ওঠে চামড়া শিল্প নগরী। বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচাতে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ২০১৭ সালে চামড়া শিল্পকে সাভারে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে সাভারে ১৪১ টি ট্যানারি রয়েছে। যেখানে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) তৈরি করা হয়।
কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ অর্জনও সম্ভব হচ্ছে না। মূলত এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না। এ খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এলডব্লিউজি সনদ অর্জনে যেসব মানদ- রয়েছে, তা পূরণে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে সরকারকে।
চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বাংলাদেশী চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশী চামড়ার বড় ক্রেতা বর্তমানে চীন। তারা কম দাম দেয়। সেটির প্রভাব কাঁচা চামড়ার দামেও পড়ছে। বাংলাদেশ থেকে চীনে যে শতকরা ৮০ ভাগ লেদার যাচ্ছে, তা মূলত ক্রাস্ট লেদার। সেগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত করে ফিনিশ লেদারে পরিণত করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে চীন।
অথচ বাংলাদেশ নিজেই যদি আধুনিক ট্যানারি শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে ফিনিশ লেদার রপ্তানি করতে পারত, তাহলে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারত।
এ শিল্পনগরীকে উন্নত করতে হলে অবকাঠামো আধুনিকীকরণ করতে হবে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনকে (বিসিক) চামড়া শিল্প নগরীর সমাধানের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আবার ট্যানারি শ্রমিকরাও ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শ্রমিকদের আবাসন ও চিকিৎসাসহ তাদের জীবনযাপনের মৌলিক চাহিদা পূরণে নেই যথাযথ ব্যবস্থা।
ট্যানারিগুলোয় স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ধরনের শ্রমিক কাজ করেন। তাদের জীবন অনেকটা দুর্বিষহ। মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত গ্রেড নয়, অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের বেতন নির্ধারিত হলেও ওভারটাইম ও ছুটি সুবিধা সীমিত। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা। সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থাও ঠিকমতো করতে পারেন না তারা। তাই শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশে জুতার বাজারেও চামড়া শিল্পের বিরাট অবদান রয়েছে। চামড়া ও চামড়াবিহীন প্রধানত দুই ধরনের জুতা তৈরি হয় দেশে। এতে আমাদের স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে কিছু পণ্য বিদেশেও রপ্তানি হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য সূত্রে জানা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি হয় ৮০ দশমিক ৯৬ কোটি ডলারের, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৭ দশমিক ৯৩ কোটি ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৫ দশমিক ০৫ কোটি ডলারের জুতা রপ্তানি হয়।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) সূত্রে জানা যায়, বিশ্বে জুতার মোট বাজারের ৫৫ শতাংশ চীনের দখলে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮ তে। তবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের এ খাতে অবদান মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে প্রায় ৯০টি দেশে বাংলাদেশের জুতা রপ্তানি হচ্ছে। চামড়া শিল্প পিছিয়ে পড়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হলো, দেশী বাজারে নতুন ব্র্যান্ড ও কোম্পানির প্রতিযোগিতা কম। কমপ্লায়েন্সের অভাব, পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে জটিলতা। পরিবেশবান্ধব চামড়া ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও ডেভেলপমেন্টমূলক কাজ না থাকা।
বাংলাদেশের পশুর চামড়ার মান ভালো, সরবরাহ বেশি হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা না থাকায় বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ২৪০ বিলিয়ন ডলারের চামড়ার বাজার আছে। ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জুতা, ট্র্যাভেল ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট, পার্টস, ওয়ার্কিং হ্যান্ড গ্লাবস প্রভৃতি। বর্তমানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, করোনা বা তার কাছাকাছি সময়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে সামগ্রিক রপ্তানি আয় ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়েছিল। এতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ১২৫ কোটি ডলার আয় হয়েছে। এ খাতে রফতানি বেশ কয়েক বছর পর শতকোটির ঘরে পৌঁছেছে।
পরিবেশ দূষণজনিত কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর থেকে এই খাতের রপ্তানি কমতে থাকে টানা দুই বছর। শতকোটি ডলারের নিচে রপ্তানি থাকার পরও এই খাতটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরটি শেষ হয়েছে ৫২ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার ২০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় দিয়ে। আগের অর্থবছরের তুলনায় অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া রপ্তানি খাতের এই ধারা ধরে রাখা যাবে কি না সেটি এখন প্রশ্ন।
এ জন্য আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের গুণগত মান বাড়াতে হবে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হলে বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ নিতে হবে। দেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্ধারিত মানদ- অর্জন করতে হবে। চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে শতভাগ কাঁচামাল আমাদের দেশে আছে। তথাপিও এই শিল্পের বিকাশ কাক্সিক্ষত মানের নেই। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত।
বিশ্ববাজারের ক্রেতারা এখন বহুমুখী উৎস থেকে চামড়া সংগ্রহ করছেন। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। এ জন্য চামড়া শিল্পকে আরও প্রতিযোগিতার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। বিশেষ করে সাভারের শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারকে আরো বেশি কার্যকর করতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী হিসেবে এর উত্তরণ ঘটাতে হবে। সম্ভাবনাময় এই খাতকে এগিয়ে নিতে বাস্তবধর্মী কার্যকর পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন।