
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভোজ্যতেলের মধ্যে সরিষার তেলই প্রধান
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভোজ্যতেলের মধ্যে সরিষার তেলই প্রধান যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৩৬ শতাংশ। সয়াবিন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল বীজ ফসল, যা বছরে প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার টন উৎপাদিত হয়। তবে এর পুরো পরিমাণ নিষ্কাশন ছাড়াই পোলট্রি ফিড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য, ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার তেলে সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ ৩০ শতাংশের নিচে ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরমিাণ ৫০ শতাংশের ওপরে এবং ওমগো-৩ ও ওমগো-৬ এর অনুপাত ১:২ বিদ্যমান, যা পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত।
ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার তেলের চাহিদা বৃিদ্ধ, অনুকূল আবহাওয়া, সরিষা আবাদে কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধি ও উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় চলতি অর্থবছরে সরিষার উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। কয়েক বছর আগেও মানুষ সরিষা তেল খাওয়া ভুলে গিয়েছিল। এখন সবাই সরিষা তেল খাচ্ছে। কারণ সয়াবিনের চেয়ে সরিষার তেলের উপকারিতা অনেক বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্রে জানা যায়, দেশে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৬ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদে উৎপাদিত সরিষার পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৩৫ লাখ টন এবং গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরিষার আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ে প্রায় ২ লাখ হেক্টর।
সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক ‘তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প’-এর আওতায় জুন ২০২৫ সালের মধ্যে প্রত্যাশার অনুকূলে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ মেটানো সম্ভব হবে। ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশে তেল জাতীয় ফসল সরিষা চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বৃদ্ধিসহ উচ্চফলনশীল জাতের দ্রুত সম্প্রসারণ ও উৎপাদন কলাকৌশলে আধুনিক পদ্ধতির অনুসরণই একমাত্র উপায়।
বাংলাদেশে সাধারণত আমন ধান চাষের পর জমি পতিত থাকে। এরপর সেই জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়। তেলের উৎপাদন বাড়াতে আমন ধানের পর জমি পতিত না রেখে স্বল্পমেয়াদি সরিষার আবাদ করা প্রয়োজন। এ জন্য দেশের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে স্বল্প জীবনকালের (১০০ থেকে ১২০ দিন) অথচ উচ্চফলনশীল আমন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন, যেগুলো মূল জমিতে চারা রোপণের মাত্র ৮০ থেকে ৯৫ দিনের মধ্যেই ঘরে তোলা যায়।
এরপর জমি পতিত না রেখে উন্নত জাতের সরিষা চাষ করা সম্ভব হচ্ছে, যেগুলো ৮০-৮৫ দিনের মধ্যে পরিপক্ব হওয়ার পর একই জমিতে আবার বোরো ধান চাষ করে প্রচলিত দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলিতে রূপান্তর করা সম্ভব হচ্ছে। কাজেই উচ্চফলনশীল ও স্বল্পমেয়াদি বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭সহ বারি সরিষা-১৮ জাতের আবাদ নিশ্চিতকরণ; শস্যবিন্যাসে উল্লিখিত সরিষার জাতগুলোর অন্তর্ভুিক্তকরণসহ পতিত জমি ও চরাঞ্চলে সরিষার জাতগুলোর আবাদ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব।
সরিষার আবাদ বাড়াতে এখন প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বল্প মেয়াদি আমন আবাদের পর স্বল্প মেয়াদি সরিষার জাত আবাদে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন জাত মাঠে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। এর ফলে আমন আবাদ শেষে সরিষা আবাদ করেও বোরো ধান চাষ করা সম্ভব। এতে কৃষক সরিষা আবাদে আরও বেশি আগ্রহী হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে সরিষার আবাদ হয় ৮ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয় ১১ লাখ ৬০ হাজার টন।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর, সমপরিমাণ জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ লাখ ২৯ হাজার টন। তথ্যমতে, এবার ১০ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। সেই হিসেবে চলতি মৌসুমে ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ২ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে।
দেশে তেলজাতীয় ফসলের আবাদ বাড়াতে ‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ শীর্ষক একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। শেষ হবে ২০২৫ সালের জুনে। প্রকল্পের ব্যয় ২২২ কোটি ১৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত বছর ১৩ হাজার ৯৭৯টি প্রদর্শনী করা হয়। এসব প্রদর্শনীতে ৩ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছিল।
তবে এবার প্রদর্শনীর সংখ্যা কমেছে। চলতি বছর ১৩ হাজার ৫৭৪ টি প্রদর্শনী করা হয়েছে। এসব প্রদর্শনীতে বীজ ও সার সবই বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমাদের যে টার্গেট, সেই সঠিক ধারাতেই রয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল ৩ বছরে ৪০ শতাংশ আমদানি কমিয়ে আনার। প্রথম বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। দ্বিতীয় বছরে যে লক্ষ্যমাত্রা আশা করি তাও পূরণ হবে। এ বছর তেলজাতীয় ফসলের আমদানি ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর আগামী বছরের মধ্যেই আমরা আমদানি ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারব।
তিনি আরও বলেন এখন শুধু তেলের চাহিদাই বিবেচনা করা হচ্ছে না, পুষ্টির কথাও বিবেচেনা করা হচ্ছে। যাতে সঠিক পুষ্টিটা কৃষকরা পায়। গ্রামে মাঠে গেলে এখন চারদিকে শুধু সরিষা। প্রকল্পের কারণে আমদানি ইতোমধ্যেই কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে গত বছর ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ আমদানি কমেছে। আশা করছি এ বছর ২৫ ভাগ আমদানি কমে আসবে।
দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী থেকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় মাত্র ৩ লাখ টন, যা চাহিদার ১২ শতাংশ। বাকি ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ ভাগ স্থানীয়ভাবে মেটাতে সরিষার আবাদ বাড়াতে কাজ করছে সরকার।
গত বছর ১০ লাখ বিঘা জমিতে সরিষা আবাদে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এ বছর তা বাড়িয়ে ১২ লাখ বিঘাতে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এতে উপকারভোগী হয়েছে ১২ লাখ পরিবার। প্রণোদনার আওতায় কৃষকদের সরিষা বীজ ও রাসায়নিক সার বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। এবারও বীজ ও সার পাচ্ছেন কৃষকরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে সরিষার আবাদ বেড়েছে ৩৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। আর গত ১০ বছরে এর আবাদ বেড়েছে প্রায় চার গুণ। কৃষকরা বলছেন, কম খরচে সরিষা আবাদে বেশি লাভ। এর সঙ্গে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সরিষার দিকে নজর কৃষকদের। অনেকে আবার সরিষা খেতে মধুও উৎপাদন করছেন।
সেক্ষেত্রে সরিষার আবাদ বাড়তি অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকেও সরিষা আবাদ ও উৎপাদনে কৃষকদের প্রণোদনাসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। ফলে এর আবাদও দিন দিন বাড়ছে। ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে সরিষার আবাদ বাড়াতে কৃষকদের সার-বীজ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হয়। বেশকিছু এলাকায় সরিষা কাটাও শুরু হয়েছে। অন্য ফসলের চেয়ে সরিষা সহজ ও অল্প খরচে চাষ করা যায়। যা খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি সুসংবাদ ।