ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩১

ফেলনা চুলে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

প্রকাশিত: ০০:৫৫, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩

ফেলনা চুলে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

.

বিশ্বে কোনো কিছুই ফেলনা নয়। সবকিছুই পরোক্ষ প্রত্যক্ষভাবে উপকারে আসে। তবে সেভাবে গঠনমূলক উপযোগ (Utility) সৃষ্টি করতে হয়। এখন আমি হেলায় উপেক্ষা করে ফেলে দেওয়া চুলের মার্কেটিংসহ অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে কিঞ্চিত তুলে ধরছি। সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে সব সময়ই চুলের মূল্যায়ন চাহিদা ছিল। চুল এখন ফ্যাশনেরও অংশ। বিশ্বজুড়ে অনেক তারকা, অভিনেতা বা মডেল পরচুলা (ডরম) ব্যবহার করেন। তাছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যেও পরচুলার প্রতি আগ্রহ তথা চাহিদা বেড়েছে। আর চাহিদা থাকায় স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশে এই পরচুলা ভিত্তিক খাতে অনেক প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। দেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এখন পরচুলা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বস্তুত পরচুলা বা নকল চুল মস্তকের এক ধরনের কৃত্রিম আবরণ বিশেষ, যা মানুষের ফেলে দেওয়া চুল বা পশুর পশম বা কৃত্রিম তস্তু দ্বারা তৈরি। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা অভিনয়ের সময়ে বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে এই পরচুলা পরিধান করা হয়। তাছাড়া যাদের মাথায় টাক বা কম চুল, তারাও পরচুলা ব্যবহার করে থাকে। সত্যি কথা বলতে, পরচুলা ব্যবহার শুধু এখন নয়। যীশু খ্রিস্টের জন্মের আগেও অনেক দেশে বিশেষ করে প্রাচীন মিসরে পরচুলা ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তবে সে সময়ে রোদের তাপ থেকে রক্ষার্থে ব্যবহার করা হতো।

সারা বিশে^ পরচুলার কদর দিন দিন বাড়ছে। আর ব্রান্ড হিসেবে বিদেশে বাংলাদেশের পরচুলার জনপ্রিয়তা প্রণিধানযোগ্য। বর্তমানে দেশে ছোট বড় মিলিয়ে দেড় শতাধিক পরচুলা তৈরির কারখানা আছে এবং বিভিন্ন দেশে রফতানি করে বছরে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়ে থাকে। এখানেই থেমে নেই। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে এর পরিসর বেড়ে চলেছে। সত্যি কথা বলতে কি, বর্তমানে যে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরচুলা কারখানা পর্যায়ে এসেছে। সে ব্যাপারে কিছু স্টাডিমূলক ন্ডচিত্র সঙ্গতকারণেই তুলে ধরার প্রয়াসী হয়েছি, যাতে ব্যবসায়ে আসার জন্য কর্মহীন যুবক আকর্ষিত উদ্বুদ্ধ হন। সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাগান্না ইউনিয়নের বৈডাঙ্গা গ্রামের উঠতি বয়সী ছেলে শাহীন রেজা। বাবা কৃষিকাজ করেন, মা গৃহিণী। মাধ্যমিকে বাণিজ্য বিভাগে পড়ার সময়ই তাঁর ব্যবসা নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে ঝিনাইদহে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক শেষে ২০০৩ সালে ঢাকায় চলে আসেন। বড় ইচ্ছে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। পরে তাঁর বড় ভাইয়ের পরামর্শে ঝিনাইদহের স্থানীয় একটি ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। অবশ্য সেখানে ভর্তি হলেও ঢাকাতেই থাকতেন শাহীন রেজা। সময় নিজের খরচ জোগাতে টিউশনির পাশাপাশি বিভিন্ন খুচরা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি। উল্লেখ্য যে, ২০০৪ সালের দিকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি মেসে থাকতেন। মজার ব্যাপার হলো যে, শাহীন রেজা ছোট বেলার স্বভাব হিসেবে গ্রাম্য অনেক অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেননি। গ্রামে কয়লা দিয়ে দাঁত পরিষ্কারের অভ্যাস ছিল। একদা দাঁত মাজার উদ্দেশ্যে কয়লা সন্ধান করছিলেন। বাসার পাশের্^ কালো কিছু ভরা পলিথিন দেখতে পান। কয়লা মনে করে হাত দিয়ে দেখেন পলিথিন ভরা ফেলনা চুল। তখন হঠাৎ তাঁর মনে উদয় হয় যে, এই চুলের তো একটা ব্যবসা রয়েছে। মাথায় এই বিষয়টি ঘুরপাক খেতে থাকে। ব্যাপারে কয়েক দিন ধরে ইন্টারনেটে পরিচিতদের কাছ থেকে পূর্বাপর জানার চেষ্টা করেন। তারপর ভেবে চিন্তে পথে নামেন এবং হাতে থাকা মাত্র ৩৪৫ টাকা দুজন কর্মী নিয়ে ফেলে দেওয়া চুল সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমে কাজ করতে গিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন ভাঙারির দোকানে চুলের খোঁজ করেন। এই উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার হাজারের বেশি হকারের সঙ্গে পরিচয় হয় শাহীন রেজার।

ব্যবসার শুরুতে আয় কম হলেও তিনি পিছ পা হননি। অবশ্য আয় কম হওয়ার পেছনে কারণ হলো তখন এই ফেলে দেওয়া চুলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষ এতটা ওয়াকিফহাল ছিল না; সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কম ছিল এবং বিদেশী ক্রেতার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না। এর মধ্যে তিন বছর কেটে যায়। ২০০৭ সালে পরিচিত এক হকারের মাধ্যমে চীনের দুজন ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তৎপর তাঁর পরচুলা ব্যবসায় হাওয়া লাগে। তবে সব লেনদেন হতো অনানুষ্ঠানিক। ঠিক বছরের মাথায় দেশের ইপিজেড ভুক্ত বড় একটি পরচুলা কারখানা থেকে ক্রয়াদেশ পান এবং এর সুবাদে আনুষ্ঠানিক লেনদেন শুরু হয়। তাঁর সৌভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। ২০১২ সালের দিকে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় ঘর ভাড়া করে প্রক্রিয়াজাত শুরু করেন। সেই থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠান বাড়তে থাকে। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠানে (হেয়ার স্টাইল) ৬৯ জন স্থায়ী কর্মীসহ প্রায় দেড় হাজার -কালীন কর্মী কাজ করেন। আশ্চর্য বিষয় হলো যে শাহীন রেজার হেয়ার স্টাইল প্রতিষ্ঠান গত ২০২১-২২ অর্থবছরে কোটি ২৪ লাখ ডলারের চুল রফতানি করে এবং তিনি রপ্তানির মাধ্যমে রপ্তানি বাণিজ্যে রৌপ্য পুরস্কারও পান। এরমধ্যে শাহীন রেজার মতো অনেক মানুষ উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশে শত শত পরচুলা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। প্রেক্ষাপটে অন্যতম উদাহরণ হিসেবে চুয়াডাঙ্গা জেলার পরচুলা ব্যবসার কথা তুলে ধরছি। সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, কেবল চুয়াডাঙ্গা জেলা থেকে প্রতিদিন টন চুল রপ্তানির উদ্দেশ্যে ঢাকায় পাঠানো হয়, যার দাম ন্যূনতম কোটি ২০ লক্ষ টাকা। এসব চুল ঢাকায় চীনা ক্রেতাদের নিকট বিক্রি করা হয়। চীনে এই চুল দিয়ে মেয়েদের উন্নতমানের পরচুলা টুপি তৈরি করা হয়। শুধু দিনাজপুর এবং চুয়াডাঙ্গা নয়। অনেক জেলাতেই গড়ে উঠছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরচুলা কারখানা।

বাংলাদেশের পরচুলার বাজার এখন ঊর্ধ্বমুখী। দিনে দিনে এর চাহিদা বিস্তৃতি লাভ করছে। দেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় ২০০টির মতো পরচুলা তৈরির কারখানা রয়েছে এবং বিদেশের বিভিন্ন দেশে এই পণ্য রপ্তানি করে কোটি কোটি ডলার অর্জিত হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, এসব কারখানায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া চীন থেকে আসা সিনথেটিক ফাইবার হিউম্যান হেয়ার দিয়ে পরচুলা তৈরি করা হয়। ব্রেইড, হ্যালোইন, ক্লাউন, পনি ব্রেইড, রেগুলার ইত্যাদি নামের পরচুলা বিশ্বের প্রায় ৩৪টি দেশে রপ্তানি করা হয়। বস্তুত অন্যান্য দেশ থাকলেও বড় পরচুলার ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র চীন। আসলে মোট পরচুলা রপ্তানির ৭২ শতাংশ হয় নীলফামারীর উত্তরা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ঈশ্বরদী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের ছয়টি কারখানা থেকে। সাধারণত বসতবাড়ি, বিউটি পারলার ময়লার ভাগার থেকে হকাররা ফেলে দেওয়া চুল সংগ্রহ করে। তাদের থেকে একাধিক হাত ঘুরে মূল ব্যবসায়ীর কাছে আসে। মানভেদে প্রতি কেজি চুলের দাম শত টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত। আর প্রক্রিয়াজাত করার পর এসব চুল প্রতি কেজি ১০ ডলার থেকে শত ডলারে বিক্রি হয়ে থাকে। পরিশেষে বলতে চাই যে ফেলে দেওয়া চুল দিয়ে আমরা কেবল কোটি কোটি ডলার অর্জন করছি না। একই সঙ্গে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে, তা কম কথা নয়? তাই খাতকে আরও শক্তিশালী ফলপ্রসূ করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

 

×