অস্থির ছিল ডলারের বাজার
করোনার ধকল সামলে উঠতে না উঠতে বছরের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তা-বে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। বিশ্বে পণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়লে ডলারের দাম লাগামহীন হয়ে পড়ে। ৮৬ থেকে বেড়ে ১২০ টাকা হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে থাকে। বিলাসী পণ্যের শতভাগ ঋণ মার্জিন ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও ঠেকানো যাচ্ছে না রিজার্ভ সংকট। ৪৬ বিলিয়ন থেকে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়ে খেলাপির তকমা কমাতে ঋণ পুনর্তফসিলকরণ ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। তারপরও ঋণ গ্রহীতারা ঠিকমতো তা পরিশোধ করছেন না। এর ফলে এক লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়।
আমদানি ব্যয় মেটাতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে। এক সময়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থাকলেও কারও মুখে কোনো টু শব্দ দেখা যায়নি। কিন্তু করোনার পরে আমদানি ব্যয় মেটাতে হলে রিজার্ভে বাড়তে থাকে চাপ। চলতি বছরের শুরুতে রিজার্ভের পরিমাণ কমেছিল ৪৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে আকাশে দেখা দেয় মেঘ। অর্থনীতিতে মারাত্মকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। দেশের প্রায় নিত্যপণ্য আমদানি নির্ভর হওয়ায় বাড়তে থাকে ডলারের চাহিদা।
এর ফলে বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে প্রতি ডলার ৮৬ টাকায় বিনিময় হলেও প্রতি মাসে বাড়তে থাকে ডলারের চাহিদা। এ কারণে দামও বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বরে ১১৫ টাকায় উঠে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক দাম নির্ধারণ করেও তা রুখতে পারেনি। পরে ব্যাংকের দাবির মুখে তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়। বাফেদার হাতে ডলার ছেড়ে দিলেও তা ১০৭ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। আর খোলা বাজারে তা ১২০ পর্যন্ত ডলার বেচাকেনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও প্রতিদিন রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।
তারপরও মিটছে না ডলারের সংকট।
কোনো ব্যবসায়ীই ঠিকমতো এলসি ঋণপত্র খুলতে পারছে না। বাধ্য হয়ে চলতি বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে ৯৫০ কোটি মার্কিন ডলার। যা আগের চেয়ে অনেক বেশি। ডলার বিক্রি করতে থাকায় রিজার্ভের পরিমাণও দিন দিন কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৪০০ কোটি (৩৪ বিলিয়ন) ডলারে নেমে গেছে। এ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ কয়েকটি তহবিলে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলার।
হুন্ডির রমরমা ব্যবসাতে রেমিটেন্সে ভাটা ॥ আমদানির লাগাম টানতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও ডলারের সংকট কমেনি। সরকার রেমিটেন্স বৃদ্ধি করতে গত জানুয়ারিতে আড়াই শতাংশ প্রণোদনাও ঘোষণা করেছে। তারপরও দেশে বৈধ চ্যানেলের চেয়ে অবৈধ পথে শুধু ঘোষণার মাধ্যমেই হুহিুতেই বেশি আসছে রেমিটেন্স। ডলার নিয়ে দেশে সংকট সৃষ্টি হওয়ায় প্রবাসী আয়ে এক দর বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে কোনো ব্যাংক বেশি দামে বিদেশ থেকে আয় সংগ্রহ করতে পারবে না। অন্যদিকে, দেশে মার্কিন ডলারের চরম সংকট দেখা দেওয়ায় সরকারের আমদানি দায় পরিশোধে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড়েও লাগামহীন খেলাপি ঋণ ॥ ২০২০ সালের মার্চে করোনা শুরু হলে গত দুই বছর ধরে ঋণ আদায়ে নানাভাবে ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের রক্ষা করতে ২০২০ সালের শুরু থেকেই মাত্র দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নবায়নে ছাড় দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল শপথ নিয়েই বলেছিলেন, ‘আজ থেকে আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না।’ ব্যাংক মালিকরাও বলেছিলেন, এটা কার্যকর করা হবে। তারপরও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। কোনোক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না। বিভিন্নভাবে ঋণ নিয়ে অনেকে ঠিকমতো তা পরিশোধ করছেন না। এর ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকার বেশি, যা মোট ঋণের প্রায় ৮ শতাংশ। সর্বশেষ হিসাব মতে, সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর নয় মাসে খেলাপি বেড়েছে ৩১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা।
বেশি দামে ডলার বিক্রি করায় জরিমানা ॥ গতবছরের মে মাস থেকে ডলারের বাজার অস্থির হয়ে যায়। এ সুযোগে কিছু মানি এক্সচেঞ্জ যোগসাজশ করায় ৮৬ টাকার ডলারের দাম ১১০ টাকা ছড়িয়ে গেছে। তা এ নিয়ে দেশে হই-চই পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক অভিযান শুরু করে। ডলারে কারসাজি করায় ২ আগস্ট পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে ৪২ মানি এক্সচেঞ্জকে শোকজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া, মার্কিন ডলারের সংকটকে পুঁজি করে অনৈতিক সুবিধা নেয় ১২ ব্যাংক। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার মজুত করে বড় অঙ্কের মুনাফা করে তারা। কোনো কোনো ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ৭৭০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের কারণে ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ও বিদেশী খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের এমডিদের কারণ দর্শানোর নোটিস দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।