প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি)
ইউরোপীয় দেশগুলো প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনায় ভুগতে হচ্ছে বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে। বিভিন্ন প্রতিবেদন ও তথ্যাদি থেকে দেখা গেছে, আগের যেকোন বছরের তুলনায় এ বছর ইউরোপীয় দেশগুলো সবচেয়ে বেশি এলএনজি কিনেছে।
ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরই বাড়তে থাকে এ চাহিদা। রাশিয়ার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর দেশটির ওপর থেকে যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের নির্ভরতা কমাতে উঠেপড়ে লেগেছে ইউরোপীয় দেশগুলো।
এনালিটিক্স গ্রুপ ইন্ডিপেনডেন্ট কমোডিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসেস থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ইউরোপীয় দেশগুলোর এলএনজির চাহিদা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে।
২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ফ্রান্সে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ৮৮ শতাংশ বেড়েছে, নেদারল্যান্ডসে বেড়েছে ১০৯ শতাংশ এবং বেলজিয়ামে বেড়েছে ১৫৭ শতাংশ।
এলএনজির জন্য ইউরোপের এই তৃষ্ণা বিশ্বের অন্যান্য অংশের দেশগুলোতে নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। একদিকে যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে তেমনি জ্বালানির পরিমাণও কমে আসছে। ফলে বিপাকে পড়েছে দেশগুলো।
এনার্জি রিসার্চ গ্রুপ র্যাপিডানের একজন এলএনজি বিশ্লেষক অ্যালেক্স মান্টন বলেন, "ইউরোপের দেশগুলো বেশি পরিমাণে অর্থ খরচ করেই নিজেদের জ্বালানির সরবরাহ ধরে রেখেছে।"
আইসিআইএস-এর পরিসংখ্যান থেকে আরো দেখা যায়, ইউরোপের বাইরের দেশগুলোতে, বিশেষ করে এশিয়ায় এলএনজির চাহিদা কতটা কমেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২১ সালের তুলনায় চাহিদা কমেছে ১০ শতাংশ। পাকিস্তানে কমেছে ১৯ শতাংশ, চীনে ২২ শতাংশ।
ব্ল্যাকআউটের কবলে বাংলাদেশ
প্রায় এক দশক পর, গত সপ্তাহে সবচেয়ে ভয়াবহ ব্ল্যাকআউটের শিকার হয় বাংলাদেশ। ৪ অক্টোবর দুপুর ২টা ৫ মিনিটে জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় দেখা দেয়। এর ফলে সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ডুবে যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বড় একটি অংশ। এর আগে এর চেয়ে দীর্ঘ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্নতার ঘটনা ঘটলেও সেগুলোর অধিকাংশই ঘটেছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিদ্যুৎ সরবারহ পুনরায় চালু হতে শুরু করলেও ততক্ষণে ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। বিদ্যুৎহীনতার পুরো সময় ব্যবসা চালাতে হয়েছে ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে। সম্প্রতি ডিজেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, এর ফলে ব্যবসায়ীদের সমস্যা আরও বেড়েছে।
কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশ বিশ্ব বাজার থেকে পর্যাপ্ত গ্যাসের সরবরাহের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহাম্মদ তামিম বলেন, বাংলাদেশের ব্ল্যাকআউটের প্রধান কারণ জ্বালানির ঘাটতি। তাছাড়া এর আরো একটি বড় কারণ, জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড আপগ্রেড না করা।
তিনি বলেন, "আমাদের ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিস্টেম অপারেশন আপডেট করা হয়নি। দেশে বড় বড় পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি হওয়ায় আমাদের এখন একটি স্মার্ট গ্রিড দরকার।"
ইউরোপীয় দেশগুলোর কারণে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "ইউরোপ যেখান থেকেই পারছে সেখান থেকেই গ্যাস কেনার চেষ্টা করছে। তারা বর্তমান মজুদ থেকে শুরু করে ভবিষ্যৎ মজুদ – সবই কিনছে।"
"তাদের ক্রয়ক্ষমতাও উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। তাই স্পষ্টতই, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো এতে খুব বেশিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে," যোগ করেন তামিম।
গ্যাস সংকটে পাকিস্তানও
গত কয়েক মাস ধরে পাকিস্তানও স্বল্পমেয়াদী স্পট মার্কেটে এলএনজি কেনার জন্য লড়াই করেছে।
এলএনজি সরবরাহের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর একটি বড় সমস্যা হলো, তারা সরবরাহকারীদের সাথে যে চুক্তি করেছে সেটি।
যেসব বাণিজ্য সংস্থার সাথে পাকিস্তান চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যেগুলো নিজেরা এলএনজি উৎপাদন করতে পারে না। এমনকি এসব সংস্থার সাথে করা চুক্তিতে প্রায়ই ব্রেক ক্লজ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এর অর্থ, সরবরাহকারীরা স্বল্প নোটিশে চাইলে অন্যদের কাছেও এলএনজি বিক্রি করতে পারবে। সেক্ষেত্রে তাদের কিছু জরিমানা দিতে হবে।
কিন্তু, সংস্থাগুলো যদি অন্যদের কাছে বেশি দামে এলএনজি বিক্রি করতে পারে তাহলে তারা সহজেই জরিমানা দিয়ে পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর সাথে চুক্তি বাতিল করে ফেলে। এমনকি জরিমানা দেওয়ার পর তারা যথেষ্ট লাভও করতে পারে।
পর্যাপ্ত জ্বালানি কিনতে পাকিস্তানের এই অক্ষমতার অর্থ হলো, বিদ্যুৎ ঘাটতি দেশে দীর্ঘমেয়াদী রূপ নিতে পারে।
মান্টনের মতে, বিশ্বব্যাপী এলএনজি বাজারের চাপ শিগগিরই শেষ হবে না। "যদি ইউরোপের মতো দেশগুলোর হঠাৎ করে আরও এলএনজির প্রয়োজন হয়, তাহলে তারা কিন্তু মোট সরবরাহ বাড়াতে পারবেনা। তারা কেবল বর্তমানে মজুদকৃত এলএনজি থেকেই বাণিজ্য করতে পারবে," বলছিলেন মান্টন।
সূত্র: ডিডব্লিউ
কেআর