তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আনীত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ। কোম্পানির হেড অব এক্সটার্নাল এ্যাফেয়ার্স কর্তৃক স্বাক্ষরিত চিঠিটি গত ২৫ আগস্ট এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটে পৌঁছায় বলে প্রতিবেদকের হাতে থাকা চিঠির অনুলিপি থেকে জানা যায়।
বিএটিবির চিঠিতে বলা হয়, সিগারেট শিল্প থেকে সরকারকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ভ্যাট বাবদ মোট ২৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। আইন সংশোধনী প্রক্রিয়ায় বিএটিবি বা বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফেকচারার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি বলে চিঠিতে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া প্রস্তাবিত কিছু উপধারা, যেমন: তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ক্রয়ে বাধ্যতামূলক লাইসেন্স গ্রহণ, খুচরা শলাকা ও ফেরি করে তামাক বিক্রি নিষিদ্ধকরণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, খেলাধুলা ও শিশু পার্কের সীমানার ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধকরণ, ধূমপান এলাকার বিলুপ্তিকরণ, ই-সিগারেট ও তামাক কোম্পানির সিএসআর কর্মসূচী নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি সার্বিকভাবে তামাক ব্যবসাকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে চিঠিতে দাবি করে কোম্পানিটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫.৩ শতাংশই তামাক সেবন করে থাকে। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী, তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু এবং চিকিৎসায় বছরে প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা ব্যয় হয়, যা তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্বের তুলনায় অনেক বেশি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীনে তামাক নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক কাঠামোগত কনভেনশন এফসিটিসিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। এফসিটিসির ৫.৩ ধারা অনুযায়ী, তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কোন আইন বা নীতি প্রণয়নে তামাক কোম্পানিকে যুক্ত করার কোন সুযোগ নেই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশোধনী প্রস্তাবকে ‘বাস্তবতাবর্জিত ও অপ্রণয়নযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে কোম্পানিটি আরও দাবি করে, এই সংশোধনী প্রণীত হলে সমন্বিতভাবে সরকারের প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। এছাড়া প্রস্তাবিত খসড়ার কিছু ধারা অন্তর্ভুক্তির ফলে নকল পণ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ তামাকজাত দ্রব্যের বাজার সয়লাব হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ই-সিগারেট ও ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (এন্ডস) নিষিদ্ধের ফলেও সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হবে বলে দাবি করেছে বিএটিবি। একইসঙ্গে সংশোধনী প্রস্তাবের ব্যাপারে এনবিআরের হস্তক্ষেপও কামনা করেছে বিএটিবি।
তামাকের বহুমাত্রিক ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া এফসিটিসির সঙ্গে আরও বেশি সামঞ্জস্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ঘোষণাও দেন তিনি। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (লক্ষ্যমাত্রা ৩-এ) বাস্তবায়নে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার ২৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটেই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এর আগেও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতির খসড়া প্রস্তুতকরণ, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কতাবাণীর মুদ্রণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে এনবিআরের পদক্ষেপ চেয়ে পত্র দিয়েছে বিএটিবি, বিভিন্ন সময়ে যার তীব্র সমালোচনা করেছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ দেশে সিগারেটের চোরাচালান এবং অবৈধ তামাকপণ্যের বাণিজ্যের বাড়িয়ে তুলবে বলা দাবি করা হয় কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে।
তবে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্য ২৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম, মাত্র ১.৮ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সবচেয়ে কম দামি সিগারেটের মূল্যও বাংলাদেশের কম দামি সিগারেটের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ায় সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধ সিগারেট আসার সুযোগ নেই।
এনবিআরকে লিখিত বিএটিবির চিঠির প্রসঙ্গে গবেষণা ও তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণে উদ্যোগ অত্যন্ত সময়োপযোগী। সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়েরও উচিত হবে তামাক কোম্পানির অপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনী চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের পথ সুগম করা।’