ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে উদ্যোক্তাদের বৈঠক

চামড়া শিল্পনগরীর অব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ৬ অক্টোবর ২০২৪

চামড়া শিল্পনগরীর অব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ

সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প নগরীর অব্যবস্থাপনা

সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প নগরীর অব্যবস্থাপনা নিয়ে এ খাতের উদ্যোক্তারা বিস্তর অভিযোগ করেছেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে। তারা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় ৭০-৮০ শতাংশ কম দামে চামড়া রপ্তানি করতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মিথ্যা বলে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে চামড়া ব্যবসায়ীদের সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে করে এ খাতের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এমনকি তাদের রপ্তানিও কমে গেছে।
অন্যদিকে অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, চামড়া শিল্প ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির একটি বড় খাত হিসেবে তৈরি করা হবে। এক্ষেত্রে সাভারে যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা সমাধানে উদ্যোগ নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। 
রবিবার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা এ খাতের সমস্যা ও বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। এ সময় সংঠনটির চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন এবং সংগঠনটির প্রধান উপদেষ্টা এমএ রাশিদ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা জানান, কোনো অবকাঠামো ঠিক না করে হাজারীবাগ থেকে চামড়া ব্যবসায়ীদের সাভারে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) ঠিক না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় ৭০-৮০ শতাংশ কম দামে চামড়া রপ্তানি করতে হচ্ছে।
বৈঠক শেষে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সঙ্গে কথা বলেছি। চামড়া খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত, কারণ রপ্তানির পাশাপাশি ও দেশের অভ্যন্তরে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যে রপ্তানি বহুমুখীকরণের কথা বলছি, সেখানে চামড়া খাতের বড় একটা সুযোগ রয়েছে। তবে তাদের নানাবিধ সম্ভাবনা ও সমস্যা আছে। সেসব বিষয়ে আমরা আলাপ করেছি। তাদের ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। সেখানে পরিবেশগত দিক, অর্থায়ন, রপ্তানিতে চামড়ার সার্টিফিকেশন নিয়ে আলাপ করা হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, মোট কথা আমরা চামড়া শিল্প ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির একটি বড় খাত হিসেবে তৈরি 
করতে চাই। সেটার সম্ভাবনা আছে। চামড়া শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা খুব অভিজ্ঞ। এ খাতের একটি সুবিধা হলো এর কাঁচামাল দেশীয়। এটার সঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত জড়িত। তাই এই খাতকে সহায়তা করলে আরো একটা খাতের উন্নতি হবে।
এ সময় বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা এমএ রাশিদ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সরকারের টাকা পয়সা চাইনি। আপনারা জানেন, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের হাজারীবাগ থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সাভারে।

আমাদের এই জায়গাগুলোকে (হাজারীবাগ) রেড জোন দিয়ে রেখেছিল। তিনি বলেন, আমরা ওখানে (সাভারে) গিয়ে ব্যবসা করতে পারিনি। সিইটিপি ঠিক নেই। আগে যা বলেছিল, সব মিথ্যা কথা বলেছিল। কোনো অবকাঠামো ঠিক হয়নি, আমাদের নিয়ে গেছে। এখন অর্থ উপদেষ্টার কাছে এ সমস্যাগুলোর বিষয়ে জানানো হয়েছে। বিষয়গুলো সরকারের পক্ষ থেকে সমাধান করা হবে বলে অর্থ উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন।

আপনারা কী দাবি জানিয়েছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, আমাদের দাবি সিইটিপি ঠিক করে দেওয়া। ওনাদের কারণেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। এ কারণে সুদ মওকুফ করে আমাদের ঋণ রিসিডিউল করে দেওয়ার কথা বলেছি। বাংলাদেশ ফিনিশড  লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন সাংবাদিকদের বলেন, বিসিক শিল্প নগরীতে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেগুলো শতভাগ রপ্তানিমুখী। আমরা রপ্তানি করব, এ জন্যই আমাদের সব রকমের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সিইটিপি অসম্পূর্ণ থাকার কারণে বর্তমানে আন্তর্জাতিক যে বাজার দর আছে, আমরা তার থেকে ৭০-৮০ শতাংশ কম দামে চীনে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।

আমরা যদি এটার ভ্যালু এডিশন বাড়াতে পারি, তা হলে আগের জায়গায় যেমন ২০১৫-২০১৬ সালে দুই হাজার টাকায় চামড়া কিনতাম, আমরা আবার সেই জায়গায় যেতে পারব। তিনি বলেন, বিসিক শিল্প নগরীতে ট্যানারি মালিকদের যে অংশগ্রহণ সেটা যথার্থই ছিল। ব্যর্থ যেটা হয়েছে, সেটা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিকের কারণেই ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই ব্যর্থতার দায়ভার কোনো অবস্থাতেই ট্যানারি মালিকদের ওপর বর্তায় না। অর্থ উপদেষ্টা আমাদের কথা শুনেছেন। সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।
মতবিনিময় সভায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাভিদ সফিউল্লাহ, ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। 
এদিকে সম্প্রতি রপ্তানি নীতি ২০২৪-২০২৭-এর খসড়ার যে  অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেখানে গার্মেন্টস পণ্যের পাশাপাশি চামড়া রপ্তানিখাতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রপ্তানিতে এখনো গার্মেন্টস শিল্পের পরই চামড়া শিল্পের অবস্থান। এ শিল্পখাত উন্নয়নে বেশ কয়েক বছর ধরেই সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ কারণে সাভারের চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাবে চামড়া শিল্পখাত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি।

এমনকি দেশে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া নিয়ে এখনো সঙ্কট দূর হয়নি। এ নিয়ে এ শিল্পখাতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে চামড়া শিল্পের মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ আগামী তিন বছরের মধ্যে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন ১১০ বিলিয়ন ডলার। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান,  নীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য আনা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা। 
এছাড়াও রপ্তানি বাণিজ্যের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ়করণে রপ্তানি নীতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিকাশকে উৎসাহিত করতেও সহায়ক হবে নতুন রপ্তানি নীতি। রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী আর্থিক প্রণোদনার বিকল্প ব্যবস্থা-সংক্রান্ত নির্দেশিকা এবং রপ্তানিতে নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা সুপারিশ করা হয়েছে। রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বেশ কয়েকটি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতে সম্ভাবনাময় নতুন কিছু পণ্য ও সেবা, যেমন শাক-সবজি, হস্ত ও কারুপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া প্রধান রপ্তানিপণ্য গার্মেন্টস, চামড়া ও কৃষিজাতপণ্যের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। উল্লেখ্য, সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে ১৫৬টি ট্যানারি রয়েছে। তবে নানামুখী সঙ্কটের কারণে সবগুলো ট্যানারি এখনো উৎপাদনে যেতে পারেনি।

×