ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

জুয়েলারি শিল্প-৩

অবৈধ সোনায় বিপুল রাজস্ব ফাঁকি

রহিম শেখ

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২৫ জুন ২০২৪; আপডেট: ১০:১৪, ২৬ জুন ২০২৪

অবৈধ সোনায় বিপুল রাজস্ব ফাঁকি

স্বর্ণের গহনা। ফাইল ফটো

প্রাচীনকাল থেকেই প্রাচুর্যের অপর নাম স্বর্ণ। একে বলা হয়, অর্থের সবচেয়ে স্থায়ী রূপ। হাজার বছর ধরে মূল্যবান এই ধাতুর চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য, দীপ্তি আর চাকচিক্য মানুষকে অভিভূত করে চলেছে। হয়ত সে কারণেই এর মূল্য কখনো শূন্যে নামেনি। বরং দিন যত যাচ্ছে, ততই বাড়ছে এর মূল্য।

ঊর্ধ্বমুখী বাজার মূল্যে অলংকার হিসেবে স্বর্ণের চাহিদা বা ব্যবহারে কিছুটা ভাটা পড়েছে মনে হলেও দেশে অবাধে প্রবেশ করছে সোনা। যার অধিকাংশ আসে চোরাচালানের মাধ্যমে। ২০১৮ সালের স্বর্ণ নীতিমালায় (২১ সালে সংশোধিত) আমদানির সুযোগ দেওয়া হলেও আমদানি হচ্ছে খুবই কম।

বেশিরভাগই আসছে চোরাই পথে। এজন্য গড়ে উঠেছে বিশেষ সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট ব্যাগেজ রুলের আওতায় বৈধভাবে এবং চোরাচালান ও নানা অবৈধ উপায়ে সোনা আমদানি করছে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাগেজ নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে সরকার। ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণ আনা যাবে না অলংকার বানিয়ে। অন্যদিকে স্বর্ণ খাতের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানিতেও দেশে তুলনামূলক উচ্চ শুল্ক ও ভ্যাট আছে। যার কারণে সোনার অলংকারের দাম বেশি পড়ছে।

অন্যদিতে তুলনামূলক ভ্যাট কম ও নীতি সুবিধার কারণে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে সোনার অলংকারের দাম কম। যার কারণে দেশে সোনার অলংকার বেচা-কেনা হচ্ছে কম। অনেকে ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে সোনার অলংকার কিনে আনছেন। এর ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে দেশের ব্যবসায়ীরা হারাচ্ছেন তাদের বিনিয়োগকৃত পুঁজি আর দেশ হারাচ্ছে রাজস্ব।

স্বর্ণ নীতিমালার প্রস্তাবনায় উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ থেকে ৪০ টন সোনার চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক সমীক্ষা বলছে, দেশে স্বর্ণের চাহিদা প্রায় ৪৩ টন। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) তথ্যানুসারে, বছরে দেশের সোনার চাহিদা পূরণে ১৮-২০ টন নতুন সোনা দরকার হয়। চাহিদাকৃত সোনার মধ্যে ব্যাগেজ রুলের আওতায় আসা সোনা ও পুরনো বা তেজাবি সোনার জোগানের মাধ্যমে স্বর্ণের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে।

এতদিন ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনা কম আসলেও সম্প্রতি যাত্রীদের মাধ্যমে সোনা আসা বেড়েছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৩১ দশমিক ৪৬৮ টন স্বর্ণের বার ব্যাগেজ রুলের আওতায় আমদানি হয়েছে। যদিও এর আগে থেকেই এই মাধ্যমে এবং এর বাইরে চোরাকারবারির মাধ্যমে ৫-১০ গুণ সোনা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে এসে আবার পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 
অন্যদিকে বৈধভাবে সোনা আমদানির পরিমাণ খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের শুরু থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে সোনা আমদানি হয়েছে মাত্র ১৪৮ কেজির মতো।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে কম-বেশি ৪০ হাজার স্বর্ণ ব্যবসায়ী আছেন, যারা প্রত্যক্ষভাবে এই স্বর্ণ ব্যবসায় জড়িত। যদি একজন ব্যবসায়ী এক ভরি করে স্বর্ণ ব্যবহার/বিক্রি করেন, তাহলে বছরে দেশের স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে ১৭০.২৯ টন।

যার বর্তমান বাজার মূল্য (৯৮ হাজার টাকা/ভরি ও ১ টন-৮৫৭৩৫.৩২ ভরি) আছে প্রায় এক লাখ ৪৩ হাজার ৭৮ কোটি ৭০ লাখ ২৯ হাজার টাকা। যদি এই ব্যবহার/বিক্রির পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেশি হয় তবে স্বর্ণের চাহিদা হবে ২৫৫.৪৩৫ টন এবং এর বাজার মূল্য ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১৮ কোটি ৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। চাহিদাকৃত ওই সোনার ন্যূনতম প্রায় ২০ ভাগ চাহিদা যদি বৈধভাবে পূরণ করা সম্ভব হয় তাহলে ধরে নেওয়া যায় প্রায় ৮০ শতাংশ বা ২০৪.৩৪৮ টন বা ১ কোটি ৭৫ লাখ ১৯ হাজার ৮৪১.১৭ ভরি অবৈধ পথে আসে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ১ লাখ ৭১ হাজার ৬৯৪ কোটি ৪৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।


স্বর্ণ নীতিমালা অনুযায়ী, কেজি প্রতি সোনায় প্রযোজ্য ১৫.৫০ শতাংশ শুল্ক-কর বিবেচনায় নিলে এসব অবৈধ স্বর্ণের বিপরীতে শুল্ক-কর আসে ২৬ হাজার ৬১২ কোটি ৬৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ বছরে দেশ ওই পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর যদি ৪০ হাজার স্বর্ণ দোকানে প্রতিদিন এক ভরি হিসেবে বছরে ফাঁকি দেওয়া শুল্ক-কর প্রায় ২২ হাজার ১৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। আবার ২০২৩ সালে ব্যাগেজ রুলে ৩১ দশমিক ৪৬৮ টন আসলেও ঘোষণা ছাড়া অন্তত তিনগুণ সোনা দেশে এসেছে।

বাজুসের তথ্যানুসারে, ওই সময়ে অন্তত ২০০ টনের বেশি সোনা দেশে এসেছে। অর্থাৎ ১৪৬ টন সোনা যদি স্বর্ণ আমদানি নীতিমালা অনুযায়ী দেশে আসত তাহলেও প্রায় ১৯ হাজার ১৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকার রাজস্ব সরকারের কোষাগারে জমা হতো। যেভাবেই হিসাব করা হোক, চোরাকারবারিতে দেশ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এটা পরিষ্কার।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে জুয়েলারি খাতে বছরের রাজস্ব আসে হাজার কোটি টাকার নিচে। যেমন স্থানীয় পর্যায় থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব এসেছিল সাড়ে ৩২ কোটি টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল ৫১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ব্যাগেজ রুলের আওতায় আসা রাজস্ব যোগ করা হলেও সবমিলিয়ে হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আসে বলে মনে করছেন এনবিআর সংশ্লিষ্টরা।

সোনা চোরাচালান ও রাজস্ব আদায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাজুসের স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা হিসাব করে দেখেছি আমদানিকৃত সোনার দাম লোকাল মার্কেটের চেয়ে বেশি পড়ে যায়। কোনো ব্যবসায়ী তো বেশি দামে সোনা কিনে কম দামে বিক্রি করবে না। এ কারণে সোনা আমদানির জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘দেশে অলংকার শিল্পের অপার সম্ভাবনা আছে। ভ্যাট আহরণে আগামী দিনে সরকারের একটি বড় খাত হতে পারে জুয়েলারি শিল্প। 

কিন্তু অতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্সের কারণে সোনার ব্যবসায় মন্দা চলছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ক্রেতাদের কাছে সহনীয় আকারে ভ্যাট নির্ধারণ করা জরুরি। সোনা, সোনার অলংকার, রুপা বা রুপার অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা উচিত। তাহলে সোনা খাত থেকে সরকার প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে পারবে।’ এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদের মতে যথাযথ আইন ও নীতিমালার বাস্তবিক প্রয়োগের অভাবে সরকারের খাতায় রাজস্ব যোগ হচ্ছে না।

তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সোনা চোরাচালান হচ্ছে, এর বিপরীতে আইন ও নীতিমালাও রয়েছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। আইন যথাযথভাবে যাচাই না করে করা হয়েছে। আইনের উদ্দেশ্য ও পরিস্থিতির সঙ্গে বাস্তবের মিল রাখা হয়নি। যে কারণে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না।’

চোরাকারবারের নিরাপদ রুট বাংলাদেশ ॥ বাংলাদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে যত স্বর্ণ প্রবেশ করে তার অধিকাংশ পাচার হয়ে যায়। তথ্য-প্রমাণ বলছে বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের সহজ রুট হিসেবে ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশে সোনা পাচার করে। অভিনব বিভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশ হয়ে সোনা পাচার হচ্ছে। বাজুসসহ স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের তথ্যানুসারে প্রধান তিনটি কারণে বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ পাচার হয়। যার মধ্যে রয়েছে- ভারতে স্বর্ণ আমদানিতে কর বেশি।

বাংলাদেশে তুলনামূলক কম। কর বেশি হওয়ার কারণে বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশকে চোরাচালানের রুট হিসেবে বেশি ব্যবহার করা হয়। কারণ কর ফাঁকি দিয়ে কালোবাজার থেকে যদি স্বর্ণ সংগ্রহ করা যায়, তাহলে আরও বেশি লাভ। বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের সহজ রুট হিসেবে ব্যবহারের আরেকটি কারণ হচ্ছে ভারতে জুয়েলারি ব্যবসা। ভারতীয় স্বর্ণ রপ্তানির বড় বাজার রয়েছে। ভারতের জুয়েলারি ব্যবসা বিশ্ব বিখ্যাত। সে কারণে স্বর্ণের কাঁচামাল হিসেবে কালোবাজার থেকে প্রচুর স্বর্ণ সংগ্রহ করে তারা। তৃতীয় কারণ, সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যক্রম।

যেখানে আর্থিক লেনদেন স্বর্ণবারের মাধ্যমে চলে। সংশ্লিষ্টদের মতে কালোবাজারে টাকা বা অন্যান্য মুদ্রার চেয়ে স্বর্ণ বেশি নিরাপদ। কারণ এটা আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। 

২৪ ক্যারেটের স্বর্ণ আনা যাবে না অলংকার বানিয়ে ॥ বর্তমানে ২২ ক্যারেট, ২৪ ক্যারেট, ২১ কিংবা ২০ ক্যারেট এমন নানা ধরনের মানের স্বর্ণ রয়েছে। স্বর্ণের খাঁটিত্ব নির্ধারণ হয় এই ‘ক্যারেট’ দিয়ে। ২৪ ক্যারেট স্বর্ণ মানে ৯৯.৯৫ শতাংশ খাটি স্বর্ণ। ২২ ক্যারেট মানে ২ ভাগ খাদ, ২২ ভাগ স্বর্ণ। ১৮ ক্যারেট মানে ৬ ভাগ খাদ, ১৮ ভাগ স্বর্ণ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটে ব্যাগেজ নীতিমালায় বড় পরিবর্তন বলতে ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণালঙ্কার আনা যাবে না এবং ১২ বছরের কম বয়সী কেউ স্বর্ণ আনতে পারবে না।

২৪ ক্যারেটের স্বর্ণকে একটি বড় আকারের চুড়ি বানিয়ে নিয়ে আসার প্রবণতা সম্প্রতি বেড়ে গিয়েছিল। সেই গয়নাটি কিন্তু আদতে গয়না নয়। ২৪ ক্যারেট দিয়ে কিন্তু গয়না তৈরিও হয় না। এটি মূলত গয়না করে আনা হয় শুল্কফাঁকি দেওয়ার জন্য। সাধারণত বিদেশ ফেরত একজন যাত্রী বিনা শুল্কে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালঙ্কার আনতে পারেন। আর স্বর্ণের বার যদি আনতে হয় তাহলে বাধ্যতামূলক সরকারকে শুল্ক দিতেই হবে।

২৪ ক্যারেটের স্বর্ণ দিয়ে সরাসরি গয়না তৈরি হয় না। কারণ স্বর্ণে খাদ থাকতে হয়। ২২ ক্যারেটের অলংকার হয়, ২১ হয়, ১৮ ক্যারেটের হয়, তবে ২৪ ক্যারেটের হয় না। 
২৪ ক্যারেটের চুড়ি বা বালার নামে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা হয় মূলত বার। তারপর দেশে এনে সেই চুড়ি ভেঙে ২২ বা ২১ ক্যারেটের অলংকার তৈরি হয়। 

একভরি স্বর্ণের বারের জন্য দিতে হয় ৪ হাজার টাকা শুল্ক, সেখানে একভরি স্বর্ণের গয়নার জন্য কোনো টাকা দিতে হয় না। ১০০ ভরির একটি বার যদি কেউ ৪০ হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে আনে তার চেয়ে অলংকার বানিয়ে আনলে এক টাকাও দিতে হচ্ছে না।
৪০ হাজারই লাভ। এক যুগ ধরে ব্যাগেজ বিধিমালায় দেয়া এই সুবিধার অপব্যবহার ঠেকাতে স্বর্ণালঙ্কারের সংজ্ঞা সংযোজন করা হয়েছে ব্যাগেজ বিধিমালায়।

যেখানে ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণের অলংকারকে, বিদেশ থেকে আনা অলংকারের তালিকা থেকে বাদ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাগেজ নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে সরকার। ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণ আনা যাবে না অলংকার বানিয়ে।

×