আইএমএফ দেবে ১৪০ কোটি ডলার
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তি বাবদ প্রায় ৬৫ কোটি ডলার পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া চলমান ঋণ কর্মসূচির বাইরে আরও ৭৫ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। অর্থাৎ নতুন বছরের শুরুতে আশা করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ১৪০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে। তবে সেইক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং করবৃদ্ধিতে ব্যাপক সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নোট ছাপানোর কঠোর সমালোচনা করেছে আইএমএফ। সংস্থাটি মনে করে, দ্রুত দ্রব্যমূল্য কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। একইভাবে নোট ছাপিয়ে বেসরকারি ব্যাংককে সহায়তা করাও ঠিক হয়নি। এতে অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হবে।
সূত্রমতে, কঠিন সব শর্ত মেনেই নতুন করে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়া হবে। তবে জনজীবনে স্বস্তি দিতে আইএমএফের পরামর্শমতো আপাতত বিদ্যুতের দাম বাড়াবে না সরকার। বিষয়টি সংস্থাটিকে ইতোমধ্যে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে দুই অঙ্কের ঘরে থাকা মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে, আইএমএফ বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা বললেও সরকার তা বাড়াবে না বলে সাফ জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কক্ষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। সরকারের এই কৌশলে আইএমএফও সম্মতি দিয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ভর্তুকির চাপ কমাতে আইএমএফ বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা বলেছিল। আমরা তাদের বলেছি যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ এমনিতেই চাপে আছে। এই সময় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। আইএমএফ আমাদের কথা মেনে নিয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ধারাবাহিকতায় অর্থনীতির গতি ধীর হয়েছে, তা সামলানো অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে আইএমএফ। বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আর্থিক খাতের নানা প্রসঙ্গে আইএমএফের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন বাংলাদেশে সংস্থাটির রিভিউ মিশনের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও। ওই সময় ক্রিস পাপাজর্জিও জানান, আইএমএফ বাংলাদেশের আগের শর্ত পূরণের পর ফেব্রুয়ারিতে চতুর্থ ধাপে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার অর্থাৎ প্রায় ৬৫ কোটি ডলারের ঋণ দেবে।
এ লক্ষ্যে আগামী বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবটি আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের সভায় তোলা হবে। পর্যালোচনা শেষে অনুমোদনের পর ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্থ বিতরণ করা হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। দীর্ঘদিনেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতি, যা আইএমএফের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি। ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলেও আর্থিক খাতের সংস্কারেই গুরুত্ব দিচ্ছে আইএমএফ। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির দুটি ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
এই উদ্বেগ কাটাতে সরকারকে তারা ৬টি পরামর্শ দিয়েছে। আইএমএফ যে দুটি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তাহলো বাংলাদেশের বাজারে অব্যাহতভাবে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং নতুন টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রব্যমূল্য কমাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়াসহ কর অব্যাহতি তুলে দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের রাশ টেনে ধরা, মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার আরও নমনীয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, বাংলাদেশের বাজারে অব্যাহতভাবে খাদ্যমূল্য বাড়ছে, এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সংস্থাটি মনে করে, মূল্যস্ফীতির চাপে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
এজন্য প্রবৃদ্ধি কমবে। রাজস্ব আদায়ও কমেছে। রিজার্ভের অবস্থাও চাপের মুখে রয়েছে। নতুন টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়াতেও সংস্থাটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে আইএমএফ বিশ্বাস করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, তারা যে টাকাটা নতুন করে বাজারে ছেড়েছে, সেটা তারা দ্রুত বাজার থেকে তুলেও নেবে। তবে সেটা যদি না করে তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে যা দেশের সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়াবে। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশে কর রাজস্ব অনুপাত কম। তাই একটি স্বচ্ছ ও ন্যায্য রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জরুরি ভিত্তিতে রাজস্ব সংক্রান্ত সংস্কার করতে হবে।
বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকা- উল্লেখযোগ্যভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছে। ফলে চলতি অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে। আইএমএফ অবশ্য পূর্বাভাস দিয়েছে যে আগামী অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে অর্থনীতি চাঙা হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হবে। চলতি বছরে মূল্যস্ফীতি বার্ষিক ভিত্তিতে ১১ শতাংশে থাকলেও আগামী অর্থবছরে তা দ্রুত কমে আসবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে দাঁড়াবে বলে সংস্থাটি মনে করছে।
এর আগে আইএমএফ বলেছিল, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। অক্টোবরে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে এমন প্রাক্কলন করা হয়েছিল। আরও আগে চলতি অর্থবছরের জন্য আইএমএফের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে গত আওয়ামী লীগ সরকার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।
ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করার পরামর্শ দিয়ে আইএমএফ বলেছে, দ্রুত যেসব কাজ করতে হবে, তার মধ্যে রয়েছে সঠিকভাবে খেলাপি ঋণ চিহ্নিত করা, বর্তমানে যেসব নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রয়েছে তার কার্যকর বাস্তবায়ন এবং আর্থিক খাত পুনর্গঠনের জন্য একটি রোডম্যাপ বা পথনকশা তৈরি করা। আর্থিক খাতের সংস্কার কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে সংস্থাটি। এছাড়া বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে রফতানি খাত আরও বহুমুখী করতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পাশাপাশি সুশাসন বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে আইএমএফের পক্ষ থেকে।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। এ পর্যন্ত তিন কিস্তিতে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় করেছে সংস্থাটি। চতুর্থ কিস্তি ঋণ দেওয়ার আগে গত ৩ থেকে ১৮ ডিসেম্বর আইএমএফের ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে।
সফরে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ও বিদ্যমান ঋণের চতুর্থ কিস্তির কাঠামোগত সংস্কারের শর্ত পালন নিয়ে পর্যালোচনা করে দলটি। আইএমএফ জানিয়েছে, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ চলমান ঋণ কর্মসূচির আকার আরও ৭৫ কোটি মার্কিন ডলার বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেছে। এর ফলে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) এবং বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণের আকার দাঁড়াবে ৪০০ কোটি ডলারে।