ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

ঋণ পুনঃতফসিল

খেলাপি ঋণ কমেছে সাড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ১৫ জুলাই ২০২৪

খেলাপি ঋণ কমেছে সাড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা

খেলাপি ঋণ কম দেখাতে নানামুখী কৌশল নিচ্ছে ব্যাংক

খেলাপি ঋণ কম দেখাতে নানামুখী কৌশল নিচ্ছে ব্যাংক। অবলোপনের মাধ্যমে হিসাবের খাতা থেকে মুছে ফেলার পাশাপাশি পুনঃতফসিল কৌশল কাজে লাগানো হচ্ছে। নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বিপুল সুদ মওকুফ করে মোটা অঙ্কের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে ২০২৩ সালে। বছরজুড়ে সাড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমানো হয়েছে এ প্রক্রিয়ায়। প্রার্থিতা বাঁচাতে গত জাতীয় নির্বাচনের আগে পুনঃতফসিলের হিরিক তৈরি হয়। ফলে মাত্র তিন মাসে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নবায়ন করে সিআইবি ক্লিন (খেলাপি মুক্ত) করা হয়।  
এক বছরে সাড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংক। হিসাব অনুযায়ী ঋণ পুনঃতফসিলের দিক থেকে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দায়ী করা হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে প্রার্থী হতে সে সময় অনেক প্রার্থীই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত হন। এ ছাড়া বছর শেষে নিজেদের আর্থিক হিসাব ভালো দেখাতেও ওই প্রান্তিকে অনেক খেলাপি গ্রাহকের ঋণ উদার হস্তে নবায়ন করে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে পুনঃতফসিলের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তবে এর বিপরীতে আদায় এবং সুদ মওকুফের তথ্য দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়-  দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের তিন মাসে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়, যা আগের তিন মাসের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৯ গুণ বেশি। এক ত্রৈমাসিকের হিসাবেও এটি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

এই ঋণের প্রায় ৯২ শতাংশই পুনঃতফসিল করে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। সব মিলে ২০২৩ সালে ব্যাংক খাতে সাড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। তথ্য বলছে, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রার্থীদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে তা মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে নবায়ন বা পরিশোধ করতে হয়। আর যথাসময়ে ঋণ নবায়ন হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী নির্বাচনে যোগ্য বলে বিবেচিত হন, অন্যথায় প্রার্থী হতে পারেন না। 
সূত্রগুলো বলছে, বিগত জাতীয় নির্বাচনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বাছবিচার ছাড়াই বিপুল খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এটি সম্ভব হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সহায়তার কারণে। বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ২০২২ সালের জুলাইয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পুরো ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। ব্যাংকের পর্ষদই এখন খেলাপি ঋণ নবায়নের সিদ্ধান্ত দিতে পারছে। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালাও শিথিল করা হয়। এ ছাড়া বিশেষ বিবেচনায় কোনো খেলাপি ঋণ চার বার পর্যন্ত পুনঃতফসিলের সুযোগ রাখা হয়েছে, আগে তিন বারের বেশি পুনঃতফসিল করা যেত না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ৪৩ হাজার ৮২৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এটি আগের তিন মাসের চেয়ে সাড়ে ৯ গুণ বেশি। আগের তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ৪ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ৩ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। আর এপ্রিল থেকে জুন সময়ে পুনঃতফসিল করা হয় ১০ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা।

সব মিলে গত বছর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। আগের বছরের (২০২২ সাল) পুরো সময়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। মূলত নীতিমালায় ঢালাও ছাড় দেওয়ার কারণে ওই বছর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে রেকর্ড গড়েছিল।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, এক সময় রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার প্রবণতা বেশি ছিল। তবে পুনঃতফসিলের সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকের পর্ষদের হাত ছেড়ে দেওয়ার পর সেই প্রবণতা এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে দেখা যাচ্ছে।

২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলোই সিংহভাগ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে। এ সময়ে ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিল করে প্রায় ৪০ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা, যা মোট পুনঃতফসিল ঋণের ৯১ দশমিক ৯২ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ হাজার ২০৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ছয় ব্যাংক। আর ১ হাজার ৭২ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করে তৃতীয় অবস্থানে বিশেষায়িত খাতের ব্যাংক। আর বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলো করেছে ২৬৪ কোটি টাকা।

রেকর্ড খেলাপি ঋণ নবায়নেরও পরও গত বছরের শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে মাত্র ৯ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এতে ২০২৩ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা এক বছর আগেও ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। ফলে বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বাড়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরে প্রথম ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ অনেকটাই কমে এসেছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। আর এ কারণে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে অস্বাভাবিক বেড়েছে খেলাপি ঋণ, এর পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। 
সব মিলে মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপিঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ।

×