ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২

গ্রামীণ লোকজ মেলা হারিয়ে যাচ্ছে!

ইউনুস মিয়া, নিজস্ব সংবাদদাতা,ফটিকছড়ি

প্রকাশিত: ১২:৩৮, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

গ্রামীণ লোকজ মেলা হারিয়ে যাচ্ছে!

গ্রামীণ লোকজ মেলা, আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই মেলাগুলো গ্রামের মানুষের জন্য বিনোদনের প্রধান মাধ্যম এবং গ্রামীণ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এক সময় গ্রামে গঞ্জে মেলা বসলে তা ছিল এক অন্য রকম উৎসবের আমেজ। বাঁশি, টমটম, নাগোরদোলা, পুতুল, নকশী কাঁথা, কারুশিল্প, সার্কাস, যাত্রাপালা, জিলাপি ভাজা, রঙ বেরঙের বেলুন, লাড্ডু আর মুখরোচক খাবারের মিলনমেলা।

কিন্তু আজকের দিনে এই চিত্রটা কেমন যেন ধুয়ে মুছে যাচ্ছে।  গ্রামীণ মেলা হারিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে, এবং এই হারিয়ে যাওয়া রোধ করতে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

 গ্রামীণ লোকজ মেলার ইতিহাস অনেক পুরনো। বলা হয়ে থাকে যে, পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে বাংলার জমিদার ও নীলকররা গ্রামীণ মেলার প্রচলন শুরু করেছিলেন। এর মাধ্যমে গ্রামের মানুষজন একত্রিত হয়ে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করত এবং বিনোদনের জন্য নানা ধরণের খেলার আয়োজন করা হতো।

এছাড়া, কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে আমাদের দেশে ফসল কাটার পর বা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের সময় মেলা বসানোর রীতি ছিল। এই মেলাগুলো শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুই ছিল না, এগুলো ছিল সামাজিক মিশ্রণেরও একটি মাধ্যম।

প্রাচীনকালে, পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা, এবং অন্যান্য সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় এই মেলাগুলো অনুষ্ঠিত হতো। মেলায় হস্তশিল্প, কৃষি পণ্য, মিষ্টি, খেলনা, এবং বিভিন্ন রকমের খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করা হতো। এছাড়াও মেলায় সার্কাস, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, এবং ঝুমুর গান এর মতো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো।

গ্রামীণ মেলা কিন্তু শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি গ্রামীণ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। গ্রামীণ মেলার মাধ্যমে স্থানীয় পণ্য বাজারজাতকরণ করা হয়ে থাকে, যা কৃষক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য আয়ের একটি প্রধান উৎস। মেলায় অংশগ্রহণকারী হস্তশিল্পীরা তাদের তৈরি পণ্য বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে পারে, যা তাদের জীবিকা নির্বাহে বড় সহায়ক।

এছাড়াও, মেলায় গ্রামীণ সমাজের লোকজন একত্রিত হয়ে তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য উদযাপন করে থাকে। এটি সমাজের মধ্যে একতা এবং সংহতি বৃদ্ধি করে। তাছাড়া, মেলায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার মাধ্যমে শিশু ও কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটে।

গ্রামীণ মেলা তার পুরনো জৌলুস হারাতে বসেছে! এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো প্রযুক্তির অগ্রগতি ও আধুনিক জীবনের চাহিদা। গ্রামের মানুষ এখন টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিনোদন পাচ্ছে, যার ফলে মেলার প্রতি আগ্রহ দিন দিন কমে গেছে। আধুনিক জীবনযাত্রা, শহরীকরণ এবং বিভিন্ন ধরনের বিনোদনের আগমনে গ্রামীণ মেলা তার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে।

অন্যদিকে, সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের তেমন কোন উদ্যোগ নেই গ্রামীণ মেলাগুলো বাঁচিয়ে রাখার জন্য। অনেক গ্রামীণ মেলা এখন আর অনুষ্ঠিত হয় না, বা অনুষ্ঠিত হলেও আগের মতো তেমন জনপ্রিয়তা পায় না। এছাড়াও, পরিবেশগত ও নিরাপত্তার কারণে অনেক মেলা বন্ধ হয়ে গেছে। করোনাভাইরাস মহামারীর পর থেকে মেলাগুলোর আয়োজন আরও কমে গেছে।

সরকারকে গ্রামীণ মেলা বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মেলার আয়োজন এবং ব্যবস্থাপনার জন্য বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।

 আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে গ্রামীণ মেলার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এজন্য মিডিয়া এবং সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে মেলার আয়োজন এবং অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মেলার মাধ্যমে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে।

 গ্রামীণ মেলাগুলোকে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। বিদেশী এবং দেশীয় পর্যটকদের জন্য মেলাগুলো আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।

গ্রামীণ  লোকজ মেলা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি মূল্যবান অংশ। এটি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং গ্রামীণ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

বর্তমানে প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং আধুনিক জীবনের চাহিদার কারণে মেলাগুলো হারিয়ে যাওয়ার পথে। তবে, সঠিক উদ্যোগ এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা এই মেলাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। এজন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং গ্রামীণ মেলার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

এমনটা ভাবার অবকাশ নেই যে, গ্রামীণ মেলা নিয়ে কাজ করে আমরা পিছিয়ে যাব। বরং আমরা বলতে পারি যে, প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়া টা গৌরবের। নতুন প্রজন্ম ইতিমধ্যে  সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ভুলার পথে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন বাংলার গৌরবময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বাংলা থেকে মুছে যাবে।

মুমু

×