
খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনের সেই বিখ্যাত শিল্পকর্ম কাদায় আটকে যাওয়া গরু গাড়ি
শিল্পাচার্য জয়নুলের শেকড় ব্রহ্মপুত্র পাড়ের ময়মনসিংহ
ময়মনসিংহের পুরানো ব্রহ্মপুত্র পারের ছায়া শীতল নৈসর্গিক পরিবেশে গড়ে তোলা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে আলো ছড়াচ্ছে। প্রতিনিয়ত খুদে শিল্পীরা এখান থেকে শিল্পচর্চার পাঠ নিচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে শিল্প অনুরাগী ভক্তরা শিল্পাচার্য জয়নুলের শিল্পকর্ম দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন। ফলে সংস্কার ও আধুনিকায়নের পর নতুন সাজে সজ্জিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সাধের সংগ্রহশালা এখন বছরজুড়ে শিল্প প্রেমিক দর্শক আর খুদে শিল্পীদের পদচারণায় উৎসবমুখর ও জমজমাট থাকছে। বিশেষ করে খুদে শিল্পীদের প্রতিভা বিকাশে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা অভাবনীয় সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এর সুফল পাচ্ছে নতুন ও তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা। কবি ফরিদ আহমেদ দুলাল জানান, শিল্পাচার্যের সংগ্রহশালায় বছরজুড়ে শিল্প প্রেমিকদের পদচারণায় মুখর থাকছে। এছাড়া বছর জুড়ে খুদে শিল্পীদের শিল্পচর্চায় প্রতিভার বিকাশ ঘটছে।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শেকড় ময়মনসিংহের পুরানো ব্রহ্মপুত্র পারের এই জয়নুল সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয় বিগত ১৯৭৫ সালের বাংলা নববর্ষের দিনে এক উৎসবমুখর পরিবেশে। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এর উদ্বোধন করেন। গত ১৯৮৬ সালে নবনির্মিত দ্বিতল ভবনের উদ্বোধন করেন এরশাদ সরকারের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমদ। গণদারির মুখে বিগত ১৯৯৯ সালে সংগ্রহশালার দায়িত্ব নেয় জাতীয় জাদুঘর। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ২০০৪ সালে চার বছর মেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে বাউন্ডারি, গার্ডশেড, কটেজ, মুক্তমঞ্চ, ইনডোরে ১১০ আসনের সেমিনার কক্ষ নির্মাণ, ছবির ফ্রেমিং ও ক্যাপশনের কাজসহ মূল ভবনের সংস্কার কাজ শেষে গত ২০১০ সালে দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হলে এর পর থেকে বাড়তে থাকে দর্শনার্থীর সংখ্যা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সংগ্রহশালার জায়গায় পুরানো একতলা বাড়িটির মালিক ছিলেন ব্রিটিশ পাট ব্যবসায়ী মি. বার্টন। তার কাছ থেকে বাড়িটি খরিদ করে নিয়েছিলেন রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী নলিনী রঞ্জন সরকার। বিগত ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগেই তিনি চলে যান কলকাতায়। পরবর্তীতে তিনি আর ফিরে না আসায় পরিত্যক্ত হয় বাড়িটি। নিয়মমাফিক সরকারের পক্ষে এর মালিক হয় জেলা প্রশাসন। পরবর্তীতে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন জেলা প্রশাসন থেকে বাড়িটি লিজ নিয়ে এখানে সাধের সংগ্রহশালা গড়ে তুলে তাঁর শিল্পকর্ম সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। সেদিনের আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশের উদ্বোধনী পর্বে প্রয়াত আলোকচিত্র শিল্পী নাইব উদ্দিন আহমদসহ দেশের অসংখ্য শিল্পানুরাগী ভক্তসহ তৎকালীন জেলা প্রশাসক একেএম জালাল উদ্দিন এবং ময়মনসিংহের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার জন্ম ছিল এক বিরল ও ঐতিহাসিক ঘটনা। কেননা বাংলাদেশে এর আগে কোনো একক শিল্পীর একক শিল্পকর্ম নিয়ে কোনো গ্যালারি গড়ে তোলা হয়নি। শিল্পাচার্য জয়নুল প্রথমে সংগ্রহশালার জন্য তাঁর দুর্লভ ৭০টি শিল্পকর্ম দিয়েছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রবাদ প্রতিম শিল্পীর দীর্ঘ সাধনার এই সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘদিন নানা অব্যবস্থাপনা ও অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকলেও পরবর্তীতে নানা সংস্কার আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন কাজের ফলে জৌলুস ফিরে পায়। এর আগে অযত্ন অবহেলার কারণে শিল্পাচার্যের বেশকিছু শিল্পকর্ম নোনা ধরে বিনষ্ট হয়। একবার চুরি হয়ে যায় ১৭টি শিল্পকর্ম। যদিও পরে পুলিশ ১০টি শিল্পকর্ম উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এসব চরাই উতরাই পেরিয়ে শিল্পাচার্যের সাধের সংগ্রহশালা আজ শিল্পপ্রেমিক ভক্ত অনুরাগীদের পদচারণায় প্রাণবন্ত ও উৎসবমুখর। শিল্পাচার্যের স্মৃতি ধরে রাখতে ১৯৮২ সালে মাত্র ১৮ শিক্ষার্থী নিয়ে সংগ্রহশালার ভেতরে যাত্রা শুরু হয়েছিল জয়নুল আর্ট স্কুলের। ব্যক্তিগত দান অনুদানে শুরু হওয়া এই আর্ট স্কুলের পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের স্থানীয় পৌরসভা ও জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আর্ট স্কুলের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। বর্তমানে জয়নুল শিশু চারুপীঠে শিশু শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে।
জন্ম কিশোরগঞ্জে হলেও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শৈশব ও কৈশরের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন ময়মনসিংহে। বাবা তমিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন পুলিশ বিভাগের উপসহকারী পরিদর্শক, মা জয়নাবুন্নেছা ছিলেন গৃহিণী। কয়েক পুরুষ আগে পাবনা থেকে ময়মনসিংহ শহরের কাচিঝুলিতে পূর্ব পুরুষেরা এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। প্রথমে তিনি ময়মনসিংহ নগরীর পণ্ডিতপাড়া পাঠশালা এবং পরে জেলা স্কুল ও মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এ সময় জয়নুলকে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা যুগিয়েছেন মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের হেড মাস্টার চিন্তাহরণ মজুমদার। নগরীর আকুয়া মাদরাসা কোয়ার্টারে ছিল শিল্পাচার্যের বাড়ি। শিল্পাচার্যের শিল্পী জীবনের শুরু এখান থেকেই। তাঁর চিত্রকলার ভিত্তিও ছিল নানা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক বাহক পুরানো ব্রহ্মপুত্র পারের প্রাচীন শহর ময়মনসিংহ। এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র নদ, নদের পানি, নদের চর, চরের কাশফুল, জেলেদের নদে মাছ ধরা, জাল ফেলা, মাঝির গুণটানা, ব্রহ্মপুত্র পারে নৌকায় পারাপারের জন্য প্রতীক্ষা-এসবের সঙ্গে শিল্পাচার্য জয়নুল ছিলেন চিরচেনা ও একাত্ম। আর শিল্পাচার্য জয়নুলের শিল্পকর্মে এসবের প্রতিফলন ঘটেছে নিখুঁতভাবে। নগরীর কাচিঝুলি সাহেব কোয়ার্টার সংলগ্ন সংগ্রহশালার পার্ক থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ মোড় পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদ পারে বসে প্রথম জীবনে শিল্পাচার্য জয়নুল এঁকেছেন অসংখ্য ছবি। পরবর্তীতে শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা ব্রহ্মপুত্র পারের এসব ছবিসহ দুর্র্লভ অনেক ছবির ঠাঁই হয়েছে এই সংগ্রহশালায়। এর মধ্যে তিরিশের দশকে শিল্পীর রোমান্টিক চোখে দেখা ব্রহ্মপুত্র রেলব্রিজ ও শম্ভুগঞ্জ ঘাটসহ তীরবর্তী নানা শ্রেণি পেশার মানুষের জীবন জীবিকা, চল্লিশের দুর্ভিক্ষের চিত্রশালা, মায়ের বিশীর্ণ স্তনে অপুষ্ট শিশুর পুষ্টি সন্ধানের ব্যর্থ চেষ্টা, জলোচ্ছ্বাস নিয়ে মনপুড়া ৭০, লোক শিল্পভিত্তিক কাজ, মেক্সিকোর পাহাড়ি প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের স্কেচ ছাড়াও সংগ্রহশালায় রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সবচেয়ে সেরা জননন্দিত ছবি ঠেলাগাড়ি ও মানুষের জীবন সংগ্রাম, কাদায় দেবে যাওয়া গরুর গাড়ি চাকা ঠেলে তুলছে এক অদম্য শক্তির মানুষ, প্রতীক্ষা, দুর্ভিক্ষ, সাওতাল দম্পত্তি, কেশ বিন্যাস, দুই বোন, রমণী, সাপুড়ে মেয়ে, জীবন সংগ্রাম ও বাস্তহারার চিত্র। বর্তমানে সংগ্রহশালায় শিল্পাচার্য জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছয়টিসহ ৬২টি চিত্রকর্ম, ১২৭টি ব্যবহৃত নিদর্শন ছাড়াও ৫৩টি আলোকচিত্র সংযোজন করা হয়েছে। এসবের বাইরে শিল্পাচার্য জয়নুলের প্রতিকৃতি ও জীবনবৃত্তান্ত বোর্ড, সংগ্রহশালার ইতিবৃত্ত ও চিত্রকর্ম রয়েছে গ্যালারিতে। জাতীয় জাদুঘরে শিল্পাচার্য জয়নুলের আরও যেসব শিল্পকর্ম রয়েছে সেখান থেকে বেশ কিছু শিল্পকর্ম সংগ্রহশালায় প্রদর্শনের দাবি রয়েছে স্থানীয় ভক্ত অনুরাগীদের।
জয়নুল উদ্যান এখন বিনোদন কেন্দ্র
ময়মনসিংহের পুরানো ব্রহ্মপুত্র পারের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন উদ্যান এখন অন্যতম প্রধান বিনোদন কেন্দ্র। প্রাচীন নগরী ময়মনসিংহের কর্মব্যস্ত মানুষ একটু স্বস্তি পেতে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন ছায়া শীতল পরিবেশের এই উদ্যানে। আর বিনোদন প্রিয় নানা বয়সী ও শ্রেণি পেশার মানুষের ওপর ভর করে এই উদ্যানের ভেতরে বাইরে, আশপাশে গড়ে উঠেছে নাগরদোলা, চরকি, দোলনাসহ বিনোদনের নানা কিছু। উদ্যানের ভেতর গড়ে তোলা হয়েছে জলের কৃত্রিম ফোয়ারা, জার্নি বাই ট্রেন, ম্যাজিক বোট, নানা রাইড ও মিনি চিড়িয়াখানা। এসবের বাইরে রঙিন ও বাহারি পালতোলা নৌকায় চড়ে ব্রহ্মপুত্র দর্শন তো আছেই। বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে আছে হারিয়ে যাওয়া ঘোড়ার গাড়ি টমটম। এসব নানা আয়োজন উপভোগ করতে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন নগরবাসীসহ দেশের নানা স্থান থেকে ছুটে আসা নদী ও প্রকৃতি প্রেমিক হাজারো মানুষ। তবে জয়নুল উদ্যানের প্রকৃতি দর্শনের এই সৌন্দর্য আর স্বস্তিকে অস্বস্তিকর করে তুলেছে বেপরোয়া গতি ও উচ্চ শব্দের হর্ন বাজিয়ে ছুটে চলা একদল কিশোর হোন্ডা বাইকার। এদের দাপটে স্বস্তি নিতে আসা মানুষজন চরম বিরক্ত হলেও স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে কার্যত নির্বিকার। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। যদিও স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মধ্যে এসব বাইকারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আসছে।
সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালি উপজেলা থেকে কামরুন নাহার ও মিজানুর রহমান দম্পত্তি সন্তানদের নিয়ে ছুটিতে ময়মনসিংহে বেড়াতে এসে নগরীর ব্রহ্মপুত্র পারের জয়নুল আবেদিন উদ্যান ঘুরতে এসেছিলেন। নাগরিক জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার এরকম আয়োজন দেখতে পেয়ে দারুণ মুগ্ধ তিনি। দিনভর গল্প আর আড্ডার পাশাপাশি নৌকায় চড়ে ব্রহ্মপুত্র নদ দর্শন করেছেন বেসরকারি কোম্পানির এই কর্মকর্তার পরিবার। নগরবাসীর জন্য বিনোদনের জন্য সব আয়োজনের সঙ্গে গত পহেলা বৈশাখে কনসার্টের আয়োজন থাকায় ধন্যবাদ জানাতে ভুলেননি সিটি কর্তৃপক্ষকে।
শিল্পাচার্যের নগরীতে শিল্পের ছড়াছড়ি
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শেকড় প্রাচীন নগরী ময়মনসিংহ। শিল্পাচার্যের এই নগরীতে শিল্পচর্চা ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। নগরীর অলিগলির বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য খুদে জয়নুল। শিল্পাচার্যের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই খুদে জয়নুলরা প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হচ্ছে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। এ নিয়ে গর্বিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার উপকীপার মুকুল দত্ত জানান, শিল্পাচার্য সেদিন যে স্বপ্ন দেখতেন আজ তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। প্রতি বছর ময়মনসিংহ থেকে অসংখ্য শিল্পী তৈরি হচ্ছে। ময়মনসিংহের জীবনজীবিকা, ব্রহ্মপুত্র নদ, পালতোলা নৌকা, কাশবন, প্রতীক্ষা ও দুর্ভিক্ষসহ অসংখ্য ছবি এঁকেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল। জয়নুলের শেকড় ময়মনসিংহে শিল্পচর্চার জন্য সেদিন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল জয়নুল আর্টস স্কুল। ব্রহ্মপুত্র পারের পার্ক এলাকায় পরে সেটিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় জয়নুল সংগ্রহশালা। বর্তমানে এটি জাতীয় জাদুঘরের অধীন। শিল্পাচার্য জয়নুলের সাধের এই সংগ্রহশালাতেই চালু রয়েছে জয়নুল চারুপীঠ। এর আগে গত ২০০৫ সাল থেকে খুদে শিল্পীদের জন্য গড়ে তোলা জয়নুল আর্ট স্কুলে আর্ট শেখার সুযোগ পাচ্ছে। তবে তারও আগে জয়নুল তরফদার ও প্রয়াত অধ্যাপক মীর রেজাউল করিমের উদ্যোগে এই সংগ্রহশালায় চালু চালু করা হয়েছিল আর্টস্কুল। মূলত এই স্কুলের শিক্ষার্থীরাই পরে ছড়িয়ে পড়ে। নগরীর নতুন বাজার, মুমিনুন্নিসা কলেজ, নতুন কুড়ি স্কুলের সামনে, গোলকিবাড়ি, পাদ্রী মিশন রোডসহ নগরজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য আর্ট স্কুল। বিশেষ করে বিদ্যাময়ী সরকারি গার্লস স্কুল, জিলা স্কুল, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলসহ নগরীর নামি-দামি স্কুলের চারুকলার শিক্ষকরাই এসব প্রতিষ্ঠানের চালিকাশক্তি। এসবের বাইরে জেলা শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, উদয়ন স্কুলসহ বিভিন্ন স্কুলেও রয়েছে আর্ট শেখার সুযোগ। জয়নুল আবেদিন আর্ট স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মামুন গড়ে তুলেছেন মামুন আর্টস স্কুল। শিল্পী মামুন জানান, চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে শিশুদের আর্ট শেখাচ্ছেন। শিল্পাচার্যের স্বপ্ন পূরণের উদ্যোগ ছড়িয়ে দিতেই তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার মতে অনেকে বাসা বাড়িতে শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন আর্ট স্কুল। শিল্পাঙ্গনের উদ্যোক্তা তাপস কুমার মজুমদারের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে বেশকিছু শিশু আর্ট করছে। খুদে এসব শিশুর সঙ্গে তাদের অভিভাবকেরাও এসেছে। জাতীয় পর্যায়ে প্রতি বছর যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে, সেখানে ময়মনসিংহের শিল্পীরা মেধার স্বাক্ষর রাখছে।
শিল্পকর্ম দেখতে দর্শকদের ভিড়
ভক্ত অনুরাগীদের পদচারণায় মুখর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। ব্রহ্মপুত্র পারের এই নৈসর্গিক পরিবেশ জমজমাট এখন শিল্পানুরাগীদের আনাগোনায়। জয়নুল ভক্ত শত শত দর্শক শিল্পাচার্যের শিল্পকর্ম দেখতে এসে প্রতিদিন উৎসবমুখর করে তুলছে গোটা প্রাঙ্গণ। এতে চার দেয়ালে বন্দি জয়নুলের নন্দিত সব শিল্পকর্ম যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ভক্ত অনুরাগীসহ দর্শক টানতে শিল্পাচার্যের সাধের সংগ্রহশালাটিকে সাজানো হয়েছে আকর্ষণীয় নতুন সাজে। আর্ট কটেজ, উন্মুক্ত মঞ্চ ও সেমিনার কক্ষসহ গোটা সংগ্রহশালাকে সাজানো হয়েছে আধুনিক সাজে। নগরীর কাচিঝুলি সাহেব কোয়ার্টার ব্রহ্মপুত্র নদ পারে অবস্থিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহ শালার একতলা বাড়িটি এখন দ্বিতল বিশিষ্ট। শিল্পাচার্য জয়নুল তার ৭০টি শিল্পকর্ম দিয়েছিলেন এই সংগ্রহশালার জন্য। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মহান শিল্পীর শিল্পকর্ম ও ব্যক্তিগত স্মৃতি নিদর্শনসমূহ দর্শনের জন্য নিয়মিত ভিআইপি, কূটনীতিক, দেশী-বিদেশী দর্শক, শিল্পানুরাগী, পর্যটক, প্রশিক্ষণার্থী ও ছাত্র/ছাত্রীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সংগ্রহশালা দর্শন করতে আসছেন। বর্তমানে সংগ্রহশালাটি ময়মনসিংহ তথা বাংলাদেশের একটি ঐতিহবাহী গর্বের প্রতিষ্ঠান। সংগ্রহশালাটি ৩ দশমিক ১৯৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
জয়নুলের শিল্পকর্মের উৎস
খুবলে খাচ্ছে আগ্রাসী চক্র
একেবারে হারিয়ে না গেলেও এককালের উত্তাল ব্রহ্মপুত্র আজ যৌবনহারা, খননের পরও মরা খাল, শীর্ণ। এক সময় যে নদের প্রশস্ততা ছিল ১২-১৪ কিলোমিটার, আজ সেটি ভরাট হতে হতে স্থান ভেদে কোথাও ৫০-১০০ মিটারে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে কমেছে এর নাব্য, চঞ্চলতা। যে নদের উত্তাল ঢেউ ছাপিয়ে যেত দুকূল। সে আজ উত্তালহীন ভরা বর্ষাতেও। তার সেই তর্জন গর্জন এখন আর শোনা যায় না। ব্রহ্মপুত্রের বুক চিড়ে চলে না কোনো পালতোলা নৌকা কিংবা মালবোঝাই কোনো জাহাজ থামে না কোনো বন্দরে, ঘাটে। চরদখলের মতোই চলছে ব্রহ্মপুত্র জবরদখল। পানি শূন্য ব্রহ্মপুত্রর যে পাশ জেগে উঠছে সেখানেই হামলে পড়ছে বালু ও ভূমিখেকো আগ্রাসী চক্র। সে আজ কেবলই এক মরা গাঙ, ময়মনসিংহের পুরানো নদ ব্রহ্মপুত্র। দায়সাড়া খননসহ মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই ব্রহ্মপুত্রের এমন দশা। প্রচার রয়েছে-১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের প্রভাবে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যমুনা খাল যমুনা নদীতে রূপ নেয়। পরবর্তীতে ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখে পলি জমে বর্তমান দশায় পৌছে। অথচ বিশ শতকের গোড়ার দিকেও ব্রহ্মপুত্র ছিল বিশাল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অনেক শিল্পকর্মের উৎস ছিল এই ব্রহ্মপুত্র। শিল্পাচার্যের শিল্পী জীবনের শুরু হয়েছিল ময়মনসিংহের এই ব্রহ্মপুত্র পার থেকে। তাঁর চিত্রকলার ভিত্তিও ছিল ব্রহ্মপুত্র। নানাসব দুর্লভ ছবি দিয়ে শিল্পাচার্য ব্রহ্মপুত্র পাড়েই গড়ে তুলেন জয়নুল সংগ্রহশালা। জয়নুলের শিল্পকর্মের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের সম্পর্ক আত্মিক ও নিবিড়। অথচ এই ব্রহ্মপুত্র নদকে খুবলে খাচ্ছে বালুখেকো স্থানীয় প্রভাবশালী ড্রেজার মালিকেরা। ব্রহ্মপুত্র নদজুড়ে অসংখ্য ড্রেজার বসিয়ে দিনেরাতে অপরিকল্পিতভাবে খনন করে লুটে নিয়ে বালু। স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে ব্রহ্মপুত্র নদের বালু হরিলুটের কারবারে বিস্মিত ময়মনসিংহবাসী। অপরিকল্পিতভাবে ব্রহ্মপুত্র খননের কারণে অনেক জায়গায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। নগরীর খাকডহর থেকে কিসমত পর্যন্ত কয়েকশ পরিবার বাস করছে ভাঙনের ঝুঁকি নিয়ে। গৌরীপুরের ভাংনামারি, খোদাবক্সপুর, ঈশ্বরগঞ্জের মরিচার চর, গফরগাওয়ের চর আলগী ও নান্দাইলেও রয়েছে ভাঙনের আতঙ্ক। সরকারের ২৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্পের নানা অব্যবস্থাপনার কারনে ময়মনসিংহবাসীর আশায় চিড় ধরতে শুরু করেছে। সম্ভাবনার এই প্রকল্প এখন চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। প্রকল্পের খনন থেকে উত্তোলনের বালু নিয়েও রয়েছে নয়ছয়সহ হরিলুট কারবারের অভিযোগ। মূলত ব্রহ্মপুত্র নদ এখন স্থানীয় প্রভাবশালী বালু খেকো ড্রেজার মালিকদের আয় রোজগারের উৎসে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় জুলাই আগস্টের পট পরিবর্তনের পরও বন্ধ হয়নি অবৈধ বালু উত্তোলনের প্রতিযোগিতা।
উপ-কিপার মুকুল দত্ত যা বলেন
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার উপ-কীপার মুকুল দত্ত জানান, বিগত ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্যের ৭৫টি শিল্পকর্ম নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরের অধীনে এই সংগ্রহশালায় ১৮৯টি নিদর্শন রয়েছে। গত ২০২১-২০২২ সালে ৩১ হাজার ২৩০ জন, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৩৪ হাজার ৮৭৯ জন এবং ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৩৫ হাজার ২৮৪ জন দর্শনার্থী শিল্পচার্য জয়নুল সংগ্রহশালা ও শিল্পকর্ম দর্শন করেছেন। সংষ্কার ও আধুনিকায়নের ফলে বিদেশী শিল্পানুরাগীসহ দেশের নানা জায়গায় থেকে শিক্ষার্থী ও জয়নুল প্রেমিক ভক্ত অনুরাগীদের ভিড় বাড়ছে। গত এক বছরেই বিদেশীসহ ৩৩ হাজারের বেশি দর্শনার্থী জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন। এ থেকে সরকারের ছয় লক্ষাধিক টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। বর্তমানে ৩ বছর থেকে ১২ বছর পর্যন্ত শিশুরা ১০ টাকা, প্রাপ্ত বয়স্করা ২০ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকরা ৩০০ টাকা ও বিদেশী নাগরিকরা ৫০০ টাকা ফিয়ে জাদুঘর দেখার সুযোগ পাচ্ছে। সপ্তাহের শনি থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ১০ টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫ টা এবং শুক্রবার বিকেল ৩ টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকছে জাদুঘর। বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে থাকে জাদুঘর।
বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ
প্যানেল