
খোলা আকাশের নিচে থাকলেই বজ্রপাতে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে
দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্কের নাম বজ্রপাত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রকৃতি, উষ্ণতা বৃদ্ধি, বাতাসে সিসার পরিমাণ বাড়া, অধিক ধাতব পদার্থের ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর বাড়ছে বজ্রপাত। বছরের এই সময়টায় দেশে এই বজ্রপাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে অধিক ধাতব পদার্থের ব্যবহার, মোবাইল ফোন ব্যবহারের আধিক্য এবং এর টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়াসহ বিবিধ কারণে বজ্রপাত সংখ্যা বাড়ছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, পুলিশ প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বজ্রপাতের মৌসুমকে সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বনের জন্য পরামর্শ দেওয়া হযেছে। তীব্র দাবদাহের মধ্যে বজ্রপাতে গত ১৬ ও ১৭ এপ্রিল দুদিনে সারা দেশে অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু ঘটেছে। দেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০০ মানুষ মারা যাচ্ছে বজ্রপাতে। এদের ৭২ শতাংশই কৃষক।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানান, দেশে সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসে ৫৯ শতাংশ, আর মৌসুমি বায়ু আসার সময়ে (জুন-সেপ্টেম্বর) ৩৬ শতাংশ বজ্রপাত হয়। তবে মোট বজ্রপাতের প্রায় ৭০ শতাংশ হয় এপ্রিল থেকে জুনে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশে আসার আগের দুই মাসে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বজ্রপাতের প্রকোপ অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক বেশি হয়। বর্ষাকালে রাঙামাটি, সুনামগঞ্জ ও চট্টগ্রামে বজ্রপাত হয়। এছাড়া শীতকালে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট আর শীতের শেষে রাঙামাটি, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, বজ্রমেঘ বাতাসে ভর করে প্রবাহিত হয়। তাই বাতাসের গতিবেগ যত থাকে ততবেগেই বজ্রমেঘগুলো প্রবাহিত হয়ে থাকে। সাধারণত দেশের বাইরে থেকে আমাদের দেশে বজ্রমেঘগুলো প্রবেশ করে। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় নিয়ে থাকে।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান বলেছেন, বাংলাদেশে সাধারণত বিকেল থেকে রাত এবং ভোররাত থেকে ভোর, এই সময়ে বজ্রপাত হয়ে থাকে। মূলত সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত হলো বজ্রপাতের আদর্শ সময়। সাধারণত পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব, উত্তর এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে দেশে বজ্রমেঘগুলো প্রবেশ করে। আন্তর্জাতিকভাবে বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করছেন এই অধ্যাপক।
আবহাওয়া বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বজ্রপাতে খোলা আকাশের নিচে থাকলেই বজ্রপাতে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। আর খোলা আকাশের নিচে থাকে আমাদের শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষকেরা। আমাদের দেশে ভোরের দিকে দেশের হাওর (সিলেট, শ্রীমঙ্গল, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা) অঞ্চলের কৃষকেরা মাঠে কাজ করতে যায়। তখন ওই এলাকায় বজ্রপাতে কৃষকরা বেশি মারা যায়। এ ছাড়া মাছ ধরতে যারা বাইরে যায়, কিংবা সন্ধ্যার সময় কাজে বাইরে থাকে তারাই বজ্রপাতে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকে।
বজ্রপাতের ব্যাপ্তি প্রসঙ্গে এশিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, সব মেঘে বজ্রপাত হয় না। যে মেঘে বজ্রমেঘ রয়েছে সেসব মেঘ কোনো এলাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় বজ্রপাত ঘটায়। সাধারণ বজ্রমেঘের যে সেলটি (একটি খ-) রয়েছে সেই সেলটি একটি এলাকা অতিক্রম করতে ৩০-৪৫ মিনিট সময় নিয়ে থাকে।
তাই কোনো এলাকায় বজ্রপাত শুরু হওয়ার পর ধরেই নিতে হবে তা ৩০-৪৫ মিনিট অব্যাহত থাকবে। বজ্রপাত মূলত ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। দেশে মূলত বর্ষার আগ মুহূর্তে বেশি বজ্রপাত হলেও মে মাসে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এ মাসে গড়ে ১৩টি বজ্রমেঘ সৃষ্টি হওয়ার কথা।
বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর সূত্র জানান, ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে এ ঘোষণাতে মৃত্যুহারের সংখ্যায় কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়। দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০০ প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে এই বজ্রপাতে। ২০১৫ সাল থেকে বজ্রপাতে এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার জনের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে মারা যাওয়াদের মধ্যে বেশিরভাগই কৃষক।
আবহাওয়াবিদদের মতে, পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ৮০ লাখ বজ্রপাত সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও বজ্রপাতে একসময় অনেক মানুষের মৃত্যু হতো। কিন্তু বজ্রনিরোধক খুঁটি স্থাপন ও মানুষকে সচেতন করে মৃত্যুহার কমিয়ে আনা হয়েছে। তাই বজ্রপাতে মৃত্যুহার কমাতে বজ্রপাতের পূর্বাভাসকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমান প্রযুুক্তির কল্যাণে আমরা আগে থেকেই জানি কোন এলাকায় কোন সময় বজ্রপাত ঘটবে। অর্থাৎ কোনো এলাকার ওপর দিয়ে বজ্রমেঘ প্রবাহিত হবে কি না, তা কিন্তু বলা যায়।
রাডার সিস্টেমের মাধ্যমে বজ্রপাতের আগাম ঘোষণাগুলো স্থানীয় মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি। এ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া, রেডিও, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন বিরতি কিংবা মিডিয়ায় ঘোষণার মাধ্যমে বজ্রপাতের সময় জানিয়ে দিতে পারি। এতে স্থানীয়রা সচেতন হয়ে বজ্রপাতের ৩০-৪৫ মিনিট সময় ঘরে অবস্থান করবে।
বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বজ্রপাত প্রতিরোধের জন্য খোলা স্থানের বৈদ্যুতিক খুঁটি কিংবা টাওয়ারে লাইটনিং অ্যারেস্টার (লাইটনিং আইসোলেটরও বলা হয়) বসাতে পারি। দেশের ১৫টি জেলায় ৩৩৭টি লাইটনিং অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে। একেকটি লাইটনিং অ্যারেস্টার ১০০ বর্গমিটার এলাকা কভার করে। অর্থাৎ এ এলাকার মধ্যে কোনো বজ্রপাত হলে তা অ্যারেস্টারে আটকা পড়বে।
জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে দুই হাজার ৪০০ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম জানিয়েছে, বজ্রপাত দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশ্বে বছরে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, অর্ধেকই বাংলাদেশে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ।
জলবায়ুর প্রভাবে বিপদাপন্নতা চরম আকার ধারণ করেছে। বিশ্বে দুর্যোগ ঝুঁকির তালিকায় নবম স্থানে বাংলাদেশ। তাই আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বজ্রপাতের ডেড জোন এখন বাংলাদেশ। বজ্রপাতে মৃত্যুর চেয়ে ১০ গুণ বেশি মানুষ আহত হন। বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা বা ওষুধও নেই দেশের হাসপাতালগুলোতে।