ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

গল্প নয়-সত্যি! ইতিবাচক খবর নিয়ে হাতের লেখা পত্রিকা আন্ধারমানিক

মেজবাহউদ্দিন মাননু, নিজস্ব সংবাদদাতা,কলাপাড়া, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ২২ এপ্রিল ২০২৫

গল্প নয়-সত্যি! ইতিবাচক খবর নিয়ে হাতের লেখা পত্রিকা আন্ধারমানিক

দেশের কোথাও এমন খবর আছে কিনা তা জানা নেই। তবে এটি গল্প নয়। সত্যি। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার অজোপাড়াগাঁয়ের যুবক হাসান পারভেজ হাতে লিখে প্রকাশ করছেন কমিউনিটি পত্রিকা “আন্ধারমানিক”। ২০১৯ সালের পহেলা মে থেকে শুরু করে চলছে তার এই প্রকাশনার লড়াই। সাদামাটা শ্রমজীবী পরিবারের এক হাসান যেন পশ্চিম সোনাতলা গ্রামকে আলোকিত করে তুলেছেন। এমন অসাধ্য সাধন করতে স্ত্রী সালমা আক্তার শাহনাজকে সঙ্গে নিয়ে রাতদিন বিরামহীন শ্রম দিয়ে আসছেন। 

পড়শিসহ গ্রামের সকল শ্রেণি-পেশার সকলকে এক ছাতার তলে এনেছেন। যে যেভাবে পেরেছেন গ্রামটিকে হাতের লেখা পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তুলে ধরছেন। বাড়ি সংলগ্ন ইলিশের অভয়াশ্রম খ্যাত আন্ধারমানিক নদীর নামানুসারে পত্রিকাটির নামকরণ করেছেন। শুধু কৃষক-শ্রমজীবী হাসান ও তার স্ত্রী নয়। গ্রামের চায়ের দোকানি রবিউল ইসলাম, সেলাই মেশিনের কাজ করছেন রুশিয়া বেগম, প্রতিবন্ধী স্বামী পরিত্যাক্তা শাহনাজ বেগম, কৃষক সোহেল নাজির, জেলে জুয়েল নাজির, নিজের স্ত্রী সালমা বেগম, ভাড়াটে মোটরসাইকেল চালক শাহীন বেপারী পত্রিকাটি প্রকাশের শুরু থেকেই লিখছেন। কয়েকমাস আগে যোগ দিয়েছেন মাটি কাটা শ্রমিক মো. যুবরাজ, ট্রলি চালক জাফর সরদার, বিএসসি শিক্ষক লতিফ মাস্টার, শিক্ষার্থী আশীষ ঘরামি।  সবাই এ পত্রিকার রিপোর্টার। কেউ নিজের ঘরের কথা। কেউ মনের কথা। মনের বাসনা। কেউ গ্রামের সমস্যা-সম্ভাবনা তুলে ধরেছেন। পত্রিকাটিতে অসহায় হতদরিদ্রদের কথা যেন সবচেয়ে বেশি স্থান জুড়ে থাকছে। যেন নিজ নিজ যোগ্যতায় এসব মানুষগুলো নিজেকে প্রমাণ করছেন। প্রকাশকাল থেকে আজ অবদি হাসানের এই হাতে লেখা পত্রিকার খবরটি গণমাধ্যমেরও আলাদা খবরে পরিণত হয়েছে।

 

যেন নিজেরাও পারেন এমন মনোবাসনা নিয়ে আজ তাঁরা সবাই সফল হয়েছেন। হাসানের ভাষ্য, ‘প্রতিদিন দেশের পত্র-পত্রিকাগুলোতে অনেক নেতিবাচক খবর দেখেন, পড়েন আর শোনেন। যা তার কাছে ভাল লাগে না। তাই ইতিবাচক খবর তুলে ধরার মানষে হাতের লেখা কমিউনিটি পত্রিকা আন্ধারমানিক উপস্থাপন করে যাচ্ছেন।’ হাসান জানায় কখনো রাত তিনটা পর্যন্ত কাজ করার সময় তার স্ত্রী ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে যায়। কিন্তু কখনও অসহযোগিতা করেনি। উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির মানুষ এখন হাসানকে তাদের মুখপাত্র হিসেবে সিলেকশন করছেন। তিন কন্যা সন্তানকে নিয়ে হাসানের সংসার। অভাব কী তা হাঁড়ে হাঁড়ে উপলব্ধি হাসানের। জানালেন ইটের ভাটার শ্রমিক থেকে শুরু করে হেন কোন কাজ নেই যা করেননি। খেয়ে না খেয়ে দিন কেটেছে। কিন্তু লড়াই চালিয়ে গেছেন। হার মানেনি। শরীরটা আর মনের জোরকে পূজি করে চলছেন এখনো। হাসান ও শাহনাজ দম্পতি জানান, সংসারের চরম অভাব আর টানাপড়েনের মধ্যেও এ কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিবাচক খবর তুলে ধরার জন্য হাসানের এই প্রাণপণ প্রচেষ্টা। এই বয়সে এইচএসসি শেষ করেছেন। এখন বিএ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। দৃঢ় ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত হাসানের বিএ পাশ করবেন। আর আন্ধারমানিক নামের এ কমিউনিটি পত্রিকার মাধ্যমে তার গ্রামকে সবার সামনে তুলে ধরছেন। পিছপা হবেন না- এমন ব্রত নিয়ে এখন পর্যন্ত লড়াই চালাচ্ছেন হাসান। প্রতি দুই মাস পর পর একবার তার প্রকাশনা বের করবেন। নিজেরা রিপোর্ট লেখেন। এরপরে একজনকে দিয়ে কিছু সম্মানির বিনিময় সুন্দর হাতের লেখায় আট পৃষ্ঠার এ প্রকাশনার উপস্থাপন। সম্পাদনার কাজটিও নিজেই করছেন। প্রাঞ্জল ভাষায়, সহজভাবেই গ্রামের মানুষকে জানাচ্ছেন গ্রামেরই না জানা খবরটি।
পত্রিকার নিয়মিত পাঠক বিনয় বড়–য়া জানান, হাসানের পত্রিকাটি না পড়তে পারলে কি যেন অপূর্ণতা থেকে যায়। প্রতি সংখ্যায় গ্রামের খবরা-খবর তার মাকে পর্যন্ত পড়ে শোনাতে হয়। চা দোকানি গণেশ চন্দ্র জানান, পত্রিকাটির জন্য অপেক্ষায় থাকি। কখন হাতে পাবো। এ পত্রিকা আর হাসানের জন্য যেন এক ও অভিন্ন টান রয়েছে তাদের।

হাসান পারভেজ জানান, এখন তার পত্রিকার নিয়মিত পাঠক সংখ্যা অন্তত ৪০০ জন। পশ্চিম সোনাতলা ছাড়াও চাঁদপাড়া, আদমপুর, হোসেনপুর, ফতেহপুর, রহমতপুর, নিজকাটা, পাখিমারা, মকিমপুর গ্রামসহ আশপাশে তার পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক রয়েছে। প্রতি সংখ্যার কাগজ নিজেই পৌছে দেন। জানালেন, প্রতি সংখ্যা পত্রিকা প্রস্তুত করতে কাগজ-কলম, ফটোকপি, বাইন্ডং, পেস্টিংসহ সব খরচ নিয়ে অন্তত দুই হাজার টাকা খরচ হয়। পাঠকের কাছ থেকে একটি সংখ্যার জন্য ১০ টাকা নেন। কেউ কেউ আবার ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় ডেকে দিয়ে দেন বলেও জানান। হাসান এখন ওই গ্রামসহ আশপাশের হতদরিদ্র মানুষের কাছে এক আকাক্সক্ষার মানুষে পরিণত হয়েছেন। তাদের দুঃখ কষ্ট লাঘবে অকাতরে কাজ করে যাচ্ছেন এই মানুষটি। কেন আন্ধারমানিক নাম পত্রিকার-এমন প্রশ্নের উত্তরে হাসান বলেন-‘বাড়ির পাশের এই নদীতে আন্ধার রাতে মানিক্য জ¦লে, এই নাম তুলে ধরার জন্য তার পত্রিকার নামকরণ করেছেন।’ পত্রিকাটি সচল রাখতে তার আমৃত্যু চেষ্টা থাকবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন হাসান। বললেন, ‘আমি ভাত খাইতে না পারলেও পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ থাকবে না।’ তবে তারও আকুতি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে একটু আধুনিকায়ন করতে পারতেন।

হাসান জানালেন, তার এই অনুপ্রেরণার পেছনের একজন মানুষ রয়েছেন যার অবদান না বললেই নয়। তিনি হলেন উপক‚ল বন্ধু, সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু ভাই। তার সঙ্গে দেখার পরে তিনি এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। যা আজ বাস্তবে পরিণত।

মুমু

×