ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২

দুষ্টু লোকদেরই কেন বিদ্যুৎগতিতে উন্নতি হয়?

প্রকাশিত: ২০:০৯, ২১ এপ্রিল ২০২৫

দুষ্টু লোকদেরই কেন বিদ্যুৎগতিতে উন্নতি হয়?

ছবি: প্রতীকী

সমাজে একটি তিক্ত বাস্তবতা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়— যারা প্রতারণা ও অসততার আশ্রয় নেয়, তারাই যেন দ্রুতগতিতে উন্নতির শিখরে পৌঁছে যায়। পক্ষান্তরে, সৎ ও নীতিবান মানুষেরা থেকে যান অনেক পেছনে। প্রশ্ন ওঠে, পৃথিবী কি তবে প্রতারকদেরই জন্য তৈরি? আর যারা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়, তারা কেন বারবার পিছিয়ে পড়েন?

এই প্রেক্ষাপটে প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিটশে’র দর্শন আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ দেয়। নিটশে মনে করতেন, ক্ষমতা হচ্ছে মানব সমাজের অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা। ভালোবাসা থেকে শুরু করে রাজনীতি কিংবা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রভাব সর্বত্র বিদ্যমান।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, পৃথিবীর মানুষ মূলত দুই রকম মানসিকতার অধিকারী— একদল "মনিব মানসিকতা" আর আরেকদল "দাস মানসিকতা"-এর ধারক। মনিব মানসিকতার মানুষরা সাহসী, দৃঢ়চেতা, সৃজনশীল এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন। তারা নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পৃথিবীকে বদলে দিতে চায় এবং কোনোরূপ দ্বিধা ছাড়াই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্যদিকে, দাস মানসিকতার মানুষরা দুর্বল, দ্বিধাগ্রস্ত এবং পরিবর্তনের চেয়ে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।

নিটশে মনে করতেন, যারা দুর্বল তারা নিজেদের সীমাবদ্ধতা ঢাকতে এমন এক আদর্শ তৈরি করেন যা মূলত আত্মরক্ষামূলক। তারা বিশ্বাস করেন, পৃথিবী ন্যায়ের জন্য নয়, কেবল কষ্টসহিষ্ণুতার জন্য। এই দৃষ্টিভঙ্গিই সমাজে প্রতারকদের উত্থানের পথ সহজ করে দেয়। কারণ সৎ মানুষেরা প্রতিযোগিতার ময়দান থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন, আর প্রতারকেরা কোনো নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে সামনে এগিয়ে যান।

তবে নিটশে কেবলমাত্র নিষ্ঠুরতা ও স্বৈরাচারের পক্ষে ছিলেন না। বরং, তিনি বলতেন— নৈতিকতা এবং ক্ষমতা একে অপরের বিরোধী নয়, বরং একটি আদর্শ সমাজের জন্য এই দুইয়ের মেলবন্ধন প্রয়োজন। নিটশে’র দৃষ্টিতে প্রকৃত ‘সুপারম্যান’ সেই ব্যক্তি, যিনি সৎ, ন্যায়পরায়ণ, কিন্তু একইসঙ্গে কৌশলী, সাহসী ও ক্ষমতাবান।

তিনি বলেন, সুপারম্যান নিজের শত্রু খুঁজে বেড়ায় না, বরং নিজের মধ্যে থাকা ভয়, অলসতা ও দুর্বলতার সঙ্গে লড়াই করে। তার মধ্যে থাকে দায়িত্ববোধ, আত্মনির্ভরতা ও আত্মসমালোচনার ক্ষমতা। তিনি কারো দেওয়া ক্ষমতার অপেক্ষায় থাকেন না— নিজেই নিজের অবস্থান গড়ে তোলেন।

নিটশে মনে করেন, দাস মানসিকতার মানুষরা সমাজকে বদলানোর আশায় অভিযোগে মুখর থাকেন, কিন্তু পরিবর্তন আনতে হলে কৌশল ও আত্মশক্তির দরকার। শুধু সদিচ্ছা নয়, চাই পরিকল্পনা ও আত্মসংযম।

অতএব, প্রশ্ন যখন আসে—আমরা কি সৎ থেকেও উন্নতি করতে পারি? নিটশে’র উত্তর— হ্যাঁ, অবশ্যই পারি। তবে সৎ হওয়ার পাশাপাশি আমাদের হতে হবে শক্তিশালী, সচেতন, কৌশলী এবং নিজের অন্তরের দুর্বলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রস্তুত।

দুষ্টু লোকেরা হয়তো বিদ্যুৎগতিতে শীর্ষে উঠতে পারে, কিন্তু সেই অবস্থানে টিকে থাকতে পারে না। সত্যিকারের টিকে থাকা ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব তৈরি করতে হলে চাই এমন মানুষ, যারা নীতিবান, ক্ষমতাধর এবং দায়িত্বশীল— ঠিক যেমন নিটশে’র ‘সুপারম্যান’।

সমাজের পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন সৎ মানুষরাও কেবল ন্যায়ের আশায় বসে না থেকে নিজের মধ্যে ক্ষমতা ও নেতৃত্বের গুণ গড়ে তোলেন। কারণ, নীতিবিহীন ক্ষমতা যেমন ভয়ংকর, তেমনি ক্ষমতাবিহীন নৈতিকতাও নিষ্ক্রিয়।

ভিডিও দেখুন: https://youtu.be/Anxt_VQT50I?si=vC22AlIH1veBEhtK

এম.কে.

×