ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২

সামাজিকতা শিখুক শিশু

আহাম্মদ উল্লাহ

প্রকাশিত: ১৯:১৭, ২০ এপ্রিল ২০২৫

সামাজিকতা শিখুক শিশু

সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন মানুষ পুরোপুরিভাবে সামাজিক মানুষে পরিনত হয়। সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন বলেছেন, সামাজিকীকরণ হলো এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি, গোষ্ঠীর নিয়ম মেনে চলতে শেখে। জন্মের পর থেকে মানব শিশু সমাজের নিয়মকানুন ও রীতিনীতি শিখতে থাকে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। শিশুরা ফুলের মতো কোমল হৃদয়ের হয়। প্রাথমিক জীবনে পারিপার্শ্বিক জীবনাচরণ শিশুদের পরবর্তী জীবনের সোপান হিসেবে কাজ করে। ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, মূল্যবোধ, নৈতিকতার বিষয়গুলো শিশুরা পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, বিদ্যালয়, গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন দেখে শিখে যা সামাজিকীকরণের অংশ।
সামাজিকীকরণের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বাহন হচ্ছে পরিবার। পরিবার শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনের আদর্শ প্রতিষ্ঠান। শিশুদের মাঝে যে গুণাবলী গড়ে ওঠে তার অধিকাংশই শিশুরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। একটি শিশু তার দৈহিক, মানসিক এবং বস্তুগত ও অবস্তুগত যাবতীয় প্রয়োজন পরিবার থেকেই মেটায়। পরিবারের সদস্যদের নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আচরণ শিশুরা তাদের ভবিষ্যৎ আচরণ হিসেবে গ্রহণ করে এবং যা যা পরিবারে দেখছে প্রতিনিয়ত সেসব বাইরে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। সত্য কথা বলা, বড়দের সম্মান করা, মিথ্যা পরিহার করা, ছোটদের স্নেহ করা, ভিন্নমতকে সম্মান প্রদর্শন, ন্যায়-অন্যায়, মূল্যবোধ ইত্যাদি শেখার প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার। পরিবারের সদস্যদের পরস্পরের সম্পর্ক শিশুর মানসিক বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, চাচা, মামা, খালা নানান সম্পর্কে জড়িয়েই আমাদের পরিবার। একক পরিবারে পিতা-মাতা ও সন্তানেরা থাকে। পিতা-মাতার মধ্যে সম্পর্ক মধুর হলেই সে পরিবারের শিশুরা সুন্দর পারিবারিক পরিবেশে নিজেদের ব্যক্তিত্ব গঠন করতে সক্ষম হয়। সুস্থ ও আনন্দঘন পরিবেশে মানসিক বিকাশের ফলে শিশুরা চাপ মুক্ত থাকে এবং সবকিছু নিয়ে নিজের মধ্যে ইতিবাচক ধারণার জন্ম হয়। যে কোনো সমস্যা মোকাবিলা করার মতো শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়। শিশুদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করলে পরবর্তী সময়ে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে ওঠে এবং যা সমাজে শিশুদের সহজ ও সুন্দর জীবনযাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অপরদিকে পরিবারে একতা না থাকা এবং পরস্পরের সাহায্যসুলভ মনোভাবের অভাব শিশুর মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাছাড়া পিতা-মাতার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, মারামারি বা পারিবারিক অশান্তি বিরাজ করলে শিশুরা খারাপ মনোভাবের দিকে ধাবিত হয় যা একটি বয়সের পরে তাদেরকে অপরাধ প্রবণ করে তোলে। সন্তানদের মধ্যে তুলনা করা, একজনকে অন্যজনের চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া, মেধাবী মনে করা পরস্পরে মনোক্ষুণ্ন করে তোলে। পরিবারের মধ্যেই শিশুর সামাজিক নীতিবোধ, নাগরিক চেতনা, সহযোগিতা, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ, আত্মত্যাগ ও ভালোবাসা জন্মে থাকে। সামাজিকীকরণে পরিবারের পক্ষে যা করা সম্ভব অন্য কোনো কিছুর পক্ষে তা অচিন্তনীয়।
দ্বিতীয় ধাপে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধর্মীয় জ্ঞান মানুষকে ন্যায়-অন্যায়, নৈতিকতা, ভালো মন্দের পার্থক্যের শিক্ষা দেয়। সেবা, পারস্পরিক সাহায্য, অন্যায়, শত্রু মনোভাব পোষণ ইত্যাদির মধ্যে পাপ-পুণ্য কিংবা আত্মার প্রশান্তির বিষয়গুলো ধর্মের হাত ধরে মানুষের মাঝে বিরাজ করে। পৃথিবীর সকল ধর্ম মানুষের কল্যাণজনক বিষয়বস্তুর শিক্ষা দেয়। তাই সঠিক ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় জ্ঞান শিশুদের মধ্যে দেওয়া জরুরি। নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন থেকে শিশুরা সহজেই ব্যক্তিত্ব গঠন, সামাজিক সংহতির ধারণা লাভ, নৈতিক মানসিকতা সৃষ্টি, আদর্শ বিশ্বাস ও জীবনধারা গঠনে সহায়তা করে। এছাড়াও বিদ্যালয় এবং সহপাঠী সামাজিকীকরণে দুটি উপাদান একে অপরের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। সমাজ তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানদান করে। শিক্ষার মাধ্যমেই একটি সফল সমাজ গঠন করা সম্ভব। সুশিক্ষা গ্রহণের ফলে সমাজের মধ্যে বিদ্যমান কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, ধর্মীয় গোঁড়ামি, মানসিক সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধনী দরিদ্র ভেদাভেদ ইত্যাদি নিমূর্ল করা সম্ভব। অন্যদিকে ভালো সহপাঠীদের সহচার্যে ব্যক্তিজীবনের উন্নতি সাধন করা সম্ভব। কথায় আছে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে কিংবা সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। বন্ধু নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভালো সহপাঠীদের সংস্পর্শ শিশুদের জীবনকে ভালো পর্যায়ে নিয়ে যায়। দেশ ও জাতির কল্যাণে অগ্রগামী হয়।
কাজেই শিশুর যথাযথ সামাজিকীকরণ নিশ্চিত করতে ছোটবেলা থেকেই অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যদের অত্যন্ত সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়। যোগ্য মানুষ গড়ে তোলার মহান লক্ষ্যে প্রতিটি নাগরিকের সচেতন ভূমিকা পালন করা উচিত।

প্যানেল

×