ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

দু’শ’ বছরের প্রাচীন পালতোলা জাহাজ

এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি সংরক্ষণের উদ্যোগ

মেজবাহউদ্দিন মাননু

প্রকাশিত: ২১:৫২, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি সংরক্ষণের উদ্যোগ

কুয়াকাটায় ২০০ বছরের প্রাচীন নৌকা

কুয়াকাটায় সোনার নৌকা! শুনলেই যে কারও চমকে যাওয়ার কথা। কুয়াকাটা সৈকতের ঝাউবাগান এলাকায় জোয়ারের ঝাপটায় বালুর নিচ থেকে বেরিয়ে আসা প্রাচীন আমলের পালতোলা জাহাজটিকে স্থানীয়রা এ নামেই চেনেন। স্থায়ীভাবে এ জাহাজটি মূল আদলে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এজন্য অত্যাধুনিক দর্শনীয় স্থাপনা তৈরি করার কথা ছিল। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বিভাগ জাহাজটি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে কাজ শুরুর কথা বলেছিলেন তারা। প্রাচীন এ জাহাজ সংরক্ষণের এমন উদ্যোগ নেওয়ার খবরে পর্যটক-দর্শনার্থীসহ কুয়াকাটাবাসী আশান্বিত ছিলেন। কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত কিছুই করা হয়নি। ফলে, এখন শত বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রাচীন পালতোলা জাহাজটির কাঠগুলো নষ্ট হয়ে ক্ষয়ে পড়ছে। শ্রীহীন হয়ে গেছে। ওপরের টিনের চালটি শুধু ঠিক করা হয়েছে। তারপরও চারপাশ দিয়ে বর্ষায় পানিতে ভিজছে। যাচ্ছে নষ্ট হয়ে।
এটি সংরক্ষণে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। যেমন- জাহাজটির আদল ঠিক রেখে সংরক্ষণে চারদিকে কোমর সমান উঁচু দেওয়ালের পরে পর্যটক দর্শনার্থীরা যাতে সহজে দেখতে পাওে, এজন্য দেওয়ালের ওপরে ফাইবার জাতীয় স্বচ্ছ বাউন্ডারি করার পরিকল্পনা ছিল। ওপরে একটি দর্শনীয় ছাউনি দেওয়ার কথা ছিল। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের কাছেই থাকবে প্রাচীন আমলের পালতোলা জাহাজটির সংরক্ষণ জাদুঘর। জাহাজটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানার সুযোগ থাকবে। আকর্ষণীয় এ স্থাপনার মধ্যে প্রাচীন এ নিদর্শনটি কুয়াকাটার সৌন্দর্যের আরেক দর্শনীয় দিগন্তের সূচনা ঘটবে বলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তখন বলেছিল। কিন্তু কিছুই করা হয়নি। পর্যটকরা বলেছেন, এটিকে বেড়িবাঁধের ভেতরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করে পর্যটকের দর্শনের সুযোগ করে দেওয়া হোক। সিদ্দিক নামের একজন কেয়ারটেকার জানান, তিনি নিজেও কিছুই জানেন না এর পরিকল্পনা সম্পর্কে। এক কথায় প্রাচীন এ জাহাজটি অরক্ষিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রাথমিকভাবে এ জাহাজটি ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে কুয়াকাটা বৌদ্ধমন্দির সংলগ্ন বেড়িবাঁধের পাশে সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় পাঁচ বছর পরে প্রত্নতাত্ত্বিক এই প্রাচীন নিদর্শনটি রক্ষার জন্য আধুনিক স্থাপনা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম কুয়াকাটায় জাহাজটি পরিদর্শন করে এমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রাচীন এ জাহাজটি দর্শনে প্রতিদিন পর্যটক-দর্শনার্থী ভিড় করে। কিন্তু যথাযথ সংস্কারের অভাবে জাহাজটি অনেকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। অবকাঠামো ক্ষয়ে গেছে। গুড়া, তলার কাঠ নষ্ট হয়ে গেছে অনেকটা। এখন এটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রমতে, পালতোলা জাহাজটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রত্নসম্পদ। বাংলাদেশে ইতোপূর্বে এই ধরনের জাহাজ কখনো দেখা যায়নি। এটি কমপক্ষে দু’শ’ বছরের পুরানো। জাহাজটি জারুল কাঠের তৈরি। কাঠের পুরুত্ব সাড়ে ছয় সেন্টিমিটার। কাঠ, লোহা ও তামার পাত দিয়ে তৈরি। জাহাজটি অবিকলভাবে সংরক্ষণ করে কুয়াকাটায় আধুনিক স্থাপনার মধ্যে স্থাপন করলে পর্যটকের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় হতো। ৭২ ফুট লম্বা ২৪ ফুট প্রস্থ এবং ১০ দশমিক ৬ ফুট উঁচু জাহাজটি। এটি বালুর নিচ থেকে তোলার কাজে নগরবাড়ি থেকে ১০ জন দক্ষ শ্রমিক ছাড়াও ৪২ জনের একটি শ্রমিক দল কাজ করেছে। পাঁচ সদস্যের কপিকল দল ছিল সার্বক্ষণিক। সাতটি কপিকল ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয় স্থানীয় ২০ জন শ্রমিক। এটি উদ্ধার কালে পাটের তৈরি ছালার নিদর্শন মেলে। পাটখরি, মাদুরের অবশেষ, শিকল ও তামার অসংখ্য পাত পাওয়া যায়। ভাঙা মৃৎপাত্রের টুকরা, লোহা দস্তার তৈরি ব্যালাস্ট পাওয়া যায়। দুটি মাস্তুলের সদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গেছে। স্থানীয়ভাবে এ জাহাজটিকে সোনার নৌকা বলা হয়। কারণ, এর বাইরের আবরণ তামার পাতে মোড়ানো ছিল বলে মানুষ এমন নামকরণ করে। রাখাইন সমাজ কল্যাণ সমিতির সভাপতি এমং তালুকদারের দাবি- এ জাহাজটি রাখাইনরা ২০০ বছর আগে ব্যবহার করেছেন। মতান্তরে সাধু সওদাগরের ধান-চালের সওদার কাজে ব্যবহৃত নৌকা। কেউ কেউ পর্তুগিজদের ব্যবহৃত পালতোলা ছোট্ট জাহাজ বলেও ধারণা করছেন।
২০১২ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে কুয়াকাটা সৈকতের ঝাউবাগান সংলগ্ন বেলাভূমের নিচ থেকে স্থানীয় জেলেরা প্রথমে প্রাচীন এ জাহাজটি দেখতে পায়। সৈকতে জোয়ারের ঝাপটায় বালুর নিচ থেকে বেরিয়ে আসা প্রাচীন আমলের জাহাজটি বেরিয়ে আসে। পর্যটকসহ স্থানীয় লোকজন জাহাজটির বাইরের পিতলের প্রলেপ কেটে নিয়ে যায়। জাহাজটি নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠে একাধিক সচিত্র প্রতিবেদন তখন প্রকাশ হয়। তখন সরকারি ব্যবস্থাপনায় এটি সংরক্ষণে পুলিশি পাহারা বসানো হয়। একই বছরের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ইভাস মারে জাহাজটি পরিদর্শন করেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাটের তাড়াতাড়ি শিপিং ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইভাস মারে জাহাজটির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পর্যন্ত তখন পর্যবেক্ষণ করেন। সি প্লেনযোগে তিনি ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় এসেছিলেন। নৌকা বিষয়ে বিশেষভাবে অভিজ্ঞ এই বিশেষজ্ঞ তার জন্মস্থান ফ্রান্স থেকে তার নিজের তৈরি নৌকায় চড়ে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে আসেন। স্বচক্ষে এটির বিভিন্নদিক পর্যবেক্ষণ শেষে ইভাস মারে তখন বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এই নৌকাটি অসাধারণ এবং প্রাচীনকালের স্মৃতিবিজড়িত। নৌকাটির বয়স সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পারেননি তিনি। তবে তার ধারণা, এটি শত বছরের বেশি পুরানো। নৌকাটি গরান কাঠ দিয়ে তৈরি বলেও তিনি অনুমানের ওপরে বলেছিলেন। নৌকাটি বালুর নিচ থেকে পুরোটা উত্তোলন করে কুয়াকাটায় জাদুঘর করে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন; যাতে এটি হারিয়ে না যায়। নৌকাটির সঙ্গে এখানকার রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের সম্পর্ক রয়েছে মন্তব্য করে এ কারণে অন্য কোথাও না নেওয়ার পরামর্শ ছিল মারের। তার মতে প্রাচীন এই নৌকাটি যে অবস্থায় রয়েছে, এভাবেই সংরক্ষণ করলে দেশী-বিদেশী পর্যটক কুয়াকাটার প্রতি ভ্রমণে আকৃষ্ট হবে।’
একই বছরের ১০ জুলাই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী গবেষক গোলাম ফেরদৌস, একজন সিনিয়র ড্রাফট্সম্যান, একজন আলোকচিত্রকর এবং কলাপাড়ার তৎকালীন ইউএনও দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী নৌকাটি পর্যবেক্ষণ করেন। ওই টিমের প্রধান গোলাম ফেরদৌস তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রত্নসম্পদ। বাংলাদেশে ইতোপূর্বে এই ধরনের নৌকা এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। এটি অবিকলভাবে সংরক্ষণ করে কুয়াকাটায় স্থাপন করতে পারলে পর্যটকের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় হবে।
এর ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের নবেম্বর মাসে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বিভাগ জাহাজটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম কুয়াকাটায় এসে জাহাজটির অবস্থান শনাক্ত করেন। অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক বেগম শিরীন আক্তারকে প্রধান করে গঠিত টিমের অন্য সদস্যরা ছিলেন- সহকারী পরিচালক আফরোজা খান মিতা, আঞ্চলিক পরিচালক (খুলনা) মোঃ আব্দুল বাতেন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হক, আন্তর্জাতিক নৌকা বিশেষজ্ঞ ইভাস মারে, মি. আরনল্ড, নৌবাহিনীর একটি প্রতিনিধি দল। জাহাজটি উত্তোলন করে যথাযথভাবে সংরক্ষণের কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশী ট্র্যাডিশনাল বোট মিউজিয়াম ও চট্টগ্রামের তাড়াতাড়ি শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইভাস মারের নেতৃত্বে একটি সাব কমিটি গঠন করে নৌকাটি ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে বেড়িবাঁধের কান্ট্রি সাইডের স্লোপে একটি টিনশেডের নিচে স্থাপন করা হয়। দুইদিকে তখন বাউন্ডারি দেওয়াল করা হয়। জাহাজটি দেখাশোনার জন্য একজন নিরাপত্তা কর্মীর ব্যবস্থা রাখা হয়।
প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক এ প্রাচীন পালতোলা জাহাজটি দর্শন করছেন। বর্তমানে ওপরের টিনের চালটি নেই। ক্ষয়ে পড়ছে জাহাজটির বডি। বর্তমানে এটি এখানে না রাখার মত দিয়েছেন স্থানীয়রা। কারণ, বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ আধুনিকায়নের কাজ চলমান রয়েছে। সে কারণে বেড়িবাঁধের স্লোপে জাহাজটি রাখা ঠিক হবে না বলে মনে করছেন রাখাইনসহ স্থানীয়রা। কুয়াকাটা পৌরসভার মধ্যে সরকারি খাস জমি উদ্ধার করে দৃষ্টিনন্দনভাবে জাহাজটি দর্শনার্থীর জন্য স্থাপন করার দাবি সকলের। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এটি সংরক্ষণে আরও কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তেমন উদ্যোগ নেওয়া হবে। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ওই সময়কালীন কেউ এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে কিছু জানাতে রাজি হয়নি।

প্যানেল

×