ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

নারীশ্রমিকের বঞ্চনা

প্রকাশিত: ১৮:১৩, ১৭ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ২১:১২, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

নারীশ্রমিকের বঞ্চনা

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশের যে যাত্রা তা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য এক নির্বিঘ্নে চলার পথনির্দেশ। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শুধু লিঙ্গ বৈষম্যই নয় মর্যাদার লড়াই আভিজাত্যের গৌরব, ব্যক্তিক অনন্য সফলতা সব মিলিয়ে সামনের চলার গতি নির্বিঘ্ন, নিরবচ্ছিন্ন থাকেই না। আর সমসংখ্যক নারী মর্যাদা, বিত্ত আর অধিকারের নিরিখে কতভাবেই যে পিছু হটে তাও সমাজ সংস্কারের অলিখিত বিধি। পরিবার থেকে বৃহত্তর সামাজিক বলয়ে নারীদের যে অসহনীয় দুর্ভোগ, ব্যবধানের দুঃসহ চিত্র তাও যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রতিবন্ধকতার নিগড়। বর্তমানে বদলে যাওয়া আধুনিক বাংলাদেশ বৈষম্যবিরোধী এক সুস্থ, ব্যতিক্রমী বাতাবরণে এগিয়ে যাচ্ছে। গত জুলাইয়ের ছাত্র অভ্যুত্থানও অসাম্য বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন, যা স্বৈরাচারের ১৬ বছরের লাগাতার অপশাসনের ভিতকেও নাড়িয়ে দেয়। সেখানে নারী-পুরুষের অধিকার, আইনি কাঠামো, নৃশংসতার চরম ছোবলÑ সবই বিবেচনায় চলে আসছে। দেশের মানুষের সার্বিক কর্মযোগে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সুনির্দিষ্ট আইনি বিধানে তাদের প্রাপ্য অর্থ পেয়ে থাকেন। যা কি না এক নিয়মানুগ ব্যবস্থার অনুবর্তী। সেখানে প্রতি দিনের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমে নারী শ্রমিকের বঞ্চনার ইতিবৃত্ত বিভিন্ন তথ্য উপাত্তেও উঠে আসছে। সেটা শুধু কৃষি কিংবা শিল্পে নয় উন্নয়ন মহাযজ্ঞের অবকাঠামো নির্মাণেও দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান। যেখানে ব্যক্তি মালিকানাধীন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেখানে নারী শ্রমের যে কত অবমূল্যায়ন করা হয় তাও পরিবেশ পরিস্থিতির অসহনীয় নির্মমতা। বিশেষ করে পোশাক শিল্প-কারখানায় নারীদের শ্রম মজুরি তার পুরুষ সহকর্মীর থেকে অপেক্ষাকৃত কম। আর দালান বাড়ি, রাস্তাঘাট, উড়াল সেতু নির্মাণে নারী শ্রমিক যে কত অসাম্য আর শোষণ-বঞ্চনার আবর্তে পড়ে তাও লাগাতর যাতনা। মানবাধিকার কমিশন কিংবা বেসরকারি কোনো উন্নয়ন সংস্থা যারা সাধারণ শ্রম বিনিয়োগদের মজুরি শ্রম নিয়ে তথ্য-উপাত্ত নির্দেশ করেন তেমন চিত্রও সুখকর কিংবা স্বস্তিদায়ক নয়। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে ছাত্র আন্দোলনের যে সফল পরিণতি সেখানেও ছাত্রীদের সমান অংশগ্রহণ পরিস্থিতির ন্যায্যতা। আধুনিকতার নির্মাল্যে সমসংখ্যক নারী শুধু অফিস, আদালত নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি কাকডাকা ভোর থেকে রাত অবধি তার মূল্যবান শ্রমের বিনিময়ে শুধু শিল্প-কারখানাই নয় কৃষিতেও এনেছে সমতার যথার্থ পরিবেশ। সেটা ফসলি জমিতে বীজ রোপণ থেকে সংশ্লিষ্ট শস্য ঘরে তোলা পর্যন্ত সব ধরনের কায়িক পরিশ্রমে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে। আর প্রাচীন সমাজ বিশ্লেষকদের লেখায় আছে সমাজে কৃষি ব্যবস্থার বীজ বপিত হয় গৃহিণী নারীর মাধ্যমে। আদিম ব্যবস্থা থেকে অমানবিক দাস শ্রমনির্ভর সমাজ কাঠামোয় নারীদের সরাসরি অংশ নেওয়া সমাজ সভ্যতার এগিয়ে যাওয়া ত্বরান্বিতও করেছে। এক সময় ছিল দ্রব্যের সঙ্গে দ্রব্যের বিনিময়। কিন্তু যবে থেকে সমাজ মুদ্রা অর্থনীতিতে এগিয়ে যেতে থাকে ততই নারী-পুরুষের প্রভেদ চোখে পড়ার মতো এক অরাজক অবস্থা। সেখানে শ্রমের বেলায় তো অনেকখানি। যা কোনোভাবেই ঠেকানো গেলই না। বরং উন্নয়ন বিশ^ তেমন তারতম্য আর ব্যবধানকে যেন ক্রমান্বয়ে বাড়িয়েই দিল। যা আধুনিক সমাজ সভ্যতার দগ্ধতার নির্মম প্রদাহ।
নারী নিপীড়ন গৃহ থেকে বৃহত্তর কর্মযোগের সামাজিক বলয়ে অন্যমাত্রার অনিঃশেষ যাতনা। তবে সমসংখ্যক নারী একেবারেই পিছিয়ে নেই। নিজেদের অধিকার, স্বাধীনতা, কর্ম সময়, ধরন আর তার নিজের শ্রম বিনিয়োগ নিয়ে ওয়াকিফহাল এমনকি সচেতনও। তাই ৮ মার্চের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সফল লড়াই আর বিশে^র মানচিত্রে সমতাভিত্তিক সমাজকে এগিয়ে নিতে দৃঢ়প্রত্যয়ী। আমরা আমেরিকার বস্ত্র শিল্পে সুতা নারী শ্রমিকরা তাদের অধিকার ন্যায্যতা এবং সমতার আদলে নিজেদের তৈরি করতে দেখেছি। পরবর্তীতে তা চরম সংঘবদ্ধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়েও পড়ে। তবে উপস্থিত অভ্যুত্থান কিংবা আন্দোলন সময়ের গতিপ্রবাহে স্তিমিত হয়ে যাওয়া কিংবা পিছু হটা এক অবিচ্ছিন্ন শিকলে আটকানো। হরেক দাবি-দাওয়া শেষ অবধি কোথায় গিয়ে মোড় নেয় তাও নির্মম পালাক্রমের যাতনা। তাই একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যগগনে কেন আজও নারী অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে? এমনকি ’২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিপ্লবী ছাত্রীরাও প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন তাদের অবদানকে স্বীকৃতি না দেওয়ার সামাজিক হীনম্মন্যতার? আর কারখানায় সম্পৃক্ত নারী শ্রমিকদের আন্দোলন তো বিরাম-বিরতিহীনভাবে চলা এক লাগাতার বিক্ষোভের চরম বহির্প্রকাশ। যাকে আজও মোকাবিলা করতে হচ্ছে সমসংখ্যক যোগ্য নারীরও। প্রশ্ন উঠেছে বহুবার, একজন কারখানা কিংবা নির্মাণ নারী শ্রমিক সেই কাক ডাকা ভোরে উঠে আগে ছোট্ট পরিবারের সংসারটি সামলান। কোলের কিংবা বিদ্যালয়গামী সন্তানদের সারা দিনের নাওয়া খাওয়ার ব্যবস্থা করে তাদের কর্মস্থলে দৌঁড়াতে হয়। আর কর্তা স্বামীটি ফুলবাবুর মতো কোনো মতে সকালের নাশতা করে অফিসগামী হন। মাথায় অন্য কোনো চাপ কিংবা ভারবিহীন হয়ে নিরন্তরভাবে, নিরবচ্ছিন্নতায় দাপ্তরিক কার্যক্রমকে নির্দ্বিধায় এগিয়ে নিতে পারেন। উন্নয়নমুখী নতুন বাংলাদেশের সকল কর্মযোগের অংশীদার হয়ে নারীরা যে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তার মজুরিবৈষম্য নিয়ে আজও প্রতিবাদের ঝড়। আবার এমন তথ্য চিত্রও দৃশ্যমান নারীরা সংসারের সচ্ছলতা আর নিজের তাগিদে বিভিন্ন শ্রম বিনিয়োগে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। নিজেরা জানেও না শ্রম অধিকার কিংবা আইনি ব্যবস্থাপনাই বা কি? সারাদিন গতর খাটিয়ে যে মূল্য হাতের কাছে আসে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট। অন্যদিকে অজানাই থেকে যাচ্ছে ফারাক-তারতম্যের নিগূঢ়তম অদৃশ্য বাতাবরণ। বলা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অনধিগম্য যাত্রাপথ। সর্বাংশে তা সত্য নয়। সেখানে নারীরা জানতেও পারে না বিভাজন কেন এবং অধিকার আর ন্যায্যতার মাত্রায় তাদের বঞ্চনার ইতিবৃত্তই বাকি? লড়াই, সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার নিজেদের ইচ্ছায় কর্মযোগকে আগলেও রাখছেন। মনে হয় বেকার থাকার চাইতেও হাতের নাগালে সামান্য অর্থ তো আসছেই। যা দিয়ে নিজের নৈমিক্তিক কিছু প্রয়োজন কিংবা হাত খরচ তো জোটেই। স্বামী, পিতা কিংবা ভাইয়ের কাছে তো হাত পাততে হয় না। এটাই কি যথেষ্ট নয়?
অপরাজিতা প্রতিবেদক

প্যানেল

×