
১৪৩১ সালকে পেছনে ফেলে আমরা পদার্পণ করলাম বাংলার নববর্ষের নতুন আনন্দ-যাত্রায়। ১৪৩২ কে আমন্ত্রণ জানাতে ইতোমধ্যে সরব নৈসর্গিক বাতাবরণও। বৈশাখের নব প্রভাতের আগে চৈত্রসংক্রান্তির পালাক্রমও আবহমান বাংলার চিরায়ত বন্দনা। সেখানে সমসংখ্যক নারীর ঐতিহ্যিক কর্মযোগ সমাজ সংস্কারের অনন্য বৈভব। নান্দনিক পথযাত্রারও নিত্য নতুন আবহ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নতুন ও বদলে যাওয়া অন্যরকম বাংলাদেশে রমণীদের নিত্য নৈমিত্তিক কর্মযোগ সেই চিরস্থায়ী আবেদনের বরমাল্য। যে কোনো উৎসব আয়োজনে নারীদের সুনিপুণ নান্দনিক বোধ আর নিত্য কর্ম সাধনায় বাংলার শাশ্বত সাংস্কৃতিক চেতনায় ভর করাও পলিমাটির বরেন্দ্র অঞ্চলের চিরস্থায়ী সৌরভ। সেখানে নারীরাও থাকেন সমান অংশীদারিত্বে। বিদায়ী বছরের নানামাত্রিক দুর্ভোগ, ক্রান্তিকাল যেমন তাড়িত করেছে, পিছু ছাড়েনি। সমানভাবে কত সৌভাগ্য যে নজরকাড়া হয়েছে তাও সময়-অসময়ের ন্যায্যতা। আর বঙ্গরমণীরা আবহমান বাংলার নৈমিত্তিক শৌর্যের অবিস্মরণীয় দ্যোতনা। কর্মে, জীবন প্রবাহে, আনন্দযজ্ঞের নানামাত্রিক আয়োজনে চিরস্থায়ী বোধ সমুন্নত রাখা শাশ্বত উর্বর পলিমাটিকে নতুন মাত্রা দিয়ে যাচ্ছে বলে পণ্ডিত মহলের সুগভীর মননবোধ। টানা ১৬ বছরের দুঃশাসনে নারী সমাজ সুস্থির আর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে কোনোভাবেই আয়ত্বে আনতে না পারাও সময় পরিস্থিতির অসঙ্গতি।
ধর্ষণ আর নিপীড়নের মতো শারীরিক আর মানসিক বিপন্নতায় সমসংখ্যকের দৃশ্যমান অস্বস্তি আড়ালে-আবডালে থাকেইনি। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে তেমন অসহনীয় চিত্র বিচলিত হওয়ার মতোই। এমন সব জঘন্য কর্মকাণ্ডে প্রচলিত আইন বিধি থাকলেও বিচারের কাঠগড়া পর্যন্ত যেতে না পারা প্রতিবন্ধকতার অবরুদ্ধতা। বিভিন্ন প্রতিবেদন জানাচ্ছে নারী নির্যাতনের বিচারিক প্রক্রিয়া নাকি মাঝ পথেই রুদ্ধতার নিগড়ে আবর্তিত হয়। নিত্য সংবাদ মাধ্যমের পাতা ভারি হচ্ছে নারী ও শিশুর অত্যাচার আর শবদেহের করুণ আখ্যানে। বিশিষ্টজনরা বলছেন কন্যা শিশু ও নারী নির্যাতন উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার দগদগে ক্ষত চিহ্ন। সবচেয়ে লোমহর্ষক বিষয় কন্যা শিশুরাই সবার আগে ধর্ষণ আর হত্যার কাছে বলি হয়। কন্যা ও নারী শিশু নিপীড়নের অসহনীয় প্রতিবন্ধকতার জাল বুনছে ক্ষুদ্র পারিবারিক গণ্ডি থেকে বৃহত্তর সমাজ সংস্কারের অনিরাপত্তার বলয়। যাকে কোনোভাবেই নিবৃত্ত করা তো গেলই না বরং ফি বছর এমন অকথ্য অত্যাচার আর মরণ ফাঁদের নিত্য সংখ্যা বেড়ে যাওয়া আর এক দুর্ভোগ। সমস্বরে আওয়াজ তোলা হচ্ছে নারীরা আসলে কোথায় নিরাপদ? এমন দুর্বৃত্তায়নের শেষ পরিশেষ কি আদৌ নির্মূল হওয়ারই নয়? বলার অপেক্ষা রাখে না সমাজের সুবিধা বঞ্চিত অংশের তালিকায় বরাবরই নারীরাই আগানো থাকে। আবার পারিবারিক আর সামাজিক রূঢ়তার দুর্বিষহ যাতনায় তাদের নিত্য জীবন কখনো শঙ্কাহীন আর নির্বিঘ্ন থাকেই না। বিভিন্ন প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ্য নারীরা শুধু নির্যাতিতই হন না অনেকাংশে নির্যাতক হিসেবেও চিহ্নিত হতে পিছু হটছেন না। শাশুড়ি-বউয়ের অনিঃশেষ যন্ত্রণা কাতর প্রতিবেশ বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই নয় অনেক যৌথ পরিবারে এর প্রাবাল্য যে কত বেশি তা ভাবারও অতীত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিণতিতে যে নতুন বদলে যাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনন্য কার্যক্রম সেখানে মহিলা পরিষদের হরেক প্রতিবেদনে নারীর প্রতি সহিংস আঁচড় উঠে আসছে। যা কোনোভাবেই কাম্য ছিলই না। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে’ হরেক কাঠামো গত জটিলতায় বিচারিক প্রক্রিয়া মাঝপথে থমকে দাঁড়ানোর চিত্র অস্বস্তিকর। তাই আদুরী হত্যার বিচার এখন অবধি দেশের জন্য পরম নজির, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কঠোর নির্দেশও দুঃসহ পরিস্থিতির স্বস্তিদায়ক বিষয়। তবে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ নতুন করে সংস্কার করার সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই এসে গেছে। নির্বাচনের আগে কাঠামোগত সংস্কারের যে আয়োজন সেখানে হরেক নিপীড়ন দমন আইনও সামনে চলে আসছে। বিগত বছরের বিভিন্ন জরিপে দৃশ্যমান হয়েছে শুধু বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়াই নয় বরং বৃহত্তর এশিয়াসহ গোটা বিশ্ব এমন ক্ষতচিহ্নকে নিয়ে সমাজ সংস্কারের গতি প্রবাহে বিষফোঁড়ার মতো লেগে আছে। যার থেকে মুক্তি আদৌ মিলবে কি না তেমন বিচারের ভার তো সময়ের হাতে। স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি কিংবা পরিবারের নিকটতম সদস্যরাই নারী নিগ্রহের অধিকার নিয়ে বসে আছেন। উল্লেখ করা যায় একজন শাশুড়ি নিজেই তার শাশুড়ি, জা কিংবা ননদের হাতে কথা কিংবা শারীরিক আঘাতে জর্জরিত হওয়া বাংলাদেশের নিত্য নৈমিত্তিক পরিস্থিতির দৃশ্যমান বাস্তবতা। আবার সেই গৃহবধূ যখন শাশুড়ির ভূমিকায় বসেন তিনিও কোনো ব্যতিক্রমী চিত্র তুলে ধরতে পারেন না। তার ওপর ঘটে যাওয়া নির্বিচার নৃশংসতা সত্ত্বেও সদ্য আগত বউমার ওপর চড়াও হতে কোনো দিকে ফিরে তাকান না। বংশ পরম্পরায় চলতে থাকা এমন হতাশাব্যঞ্জক বিপরীত প্রদাহ যেন যুগ-যুগান্তরের চিরস্থায়ী বেদনা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে তথ্যউপাত্তে উপস্থাপন করে একজন কন্যা শিশুকে নাকি প্রথম ধকল পোহাতে হয় তার জন্মদাত্রী মায়ের কাছে।
বাংলা নতুন বছরের শুভ পদার্পণে আমরা আশা করব আগের সময়ের হরেক আবর্জনা, গ্লানি ধুয়ে মুছে সাফ হবে। নতুন বৈশাখের নবসূর্যোদয় সাধারণ নারী সমাজের জন্য ব্যতিক্রমী কিছু উপহার নিশ্চয়ই সামনে নিয়ে আসবে। যা সব সময়ের আরাধ্য এক অবিশ্বাস্য কল্পনা। কারণ নৃশংস অত্যাচার থামে না বরং ফি বছরই তা ক্রমান্বয়ে বাড়-বাড়ন্ত চলে যায় হাজারো প্রতিকূলতার আবর্তে। সেখানে আশার জাল বোনা ১৪৩২ সাল নারীদের জন্য বয়ে আনবে নতুন এক জগৎ, ভিন্ন মাত্রার বাতাবরণ। যে কোনো দুঃসহ পালাক্রম একেবারে মুছে যাওয়া কঠিন। তবে অল্প করেও যদি গ্লানি, কুসংস্কার মুছে যাওয়ার রথযাত্রায় শামিল হয় তাতে আগামীর প্রজন্ম নতুন এক বাসযোগ্য পৃথিবী পেতে পারে। অসাধ্য কিছুই নয়। সবই নিজেদের ভালো-মন্দ বিচার-বিবেচনার কঠিন অর্গল। যা ঘরে ঘরে উন্মুক্ত করা পারিবারিক নির্মল আবহের শুভ কর্মপথে নির্ভয়ে ধর গানের মতো।
প্যানেল