ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ৩ বৈশাখ ১৪৩২

নীলকন্ঠের রহস্য, শ্মশানচারীর বিয়ের আয়োজন

শংকর লাল দাশ, স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ১৩:০৯, ১৫ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ১৩:৫৪, ১৫ এপ্রিল ২০২৫

নীলকন্ঠের রহস্য, শ্মশানচারীর বিয়ের আয়োজন

ছবি : জনকণ্ঠ

চৈত্র মাস এলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীল পাগলের দল। যেখানে একজন মানুষকে শিব রূপে সাজানো হয় পাগলের সাজে। সারা শরীরে যার মাছ ধরার জাল পেচানো। তার নিচে ছেড়া টুকরো রঙিন কাপড় চোপড়। মাথায় লম্বা চুল। মুখে ঘন সাদাকালো লম্বা দাড়ি গোঁফ। চোখে কালো চশমা। হাতে কাঠের তরবারি। মাথায় লাল জবা। পায়ে ঘুঙুর। এই যে শিবের রূপ। তা কিন্তু নিরর্থক কোনো বেশ নয়। সাজসজ্জার প্রতিটি উপকরণই যথেষ্ট অর্থবোধক। 

 

 

নীল পাগল কেন বলা হয়? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে শিবের এই অদ্ভুদ সাজসজ্জার কারণ কিছুটা হলেও জানা যাবে। বাকিটা না হয় পরে বুঝিয়ে বলা যাবে। পুরাণে বলা হয়েছে, শিবের আরেক নাম নীলকণ্ঠ। তাই নীল পাগল বলা হয়। বিষয়টি আসলে ততটা সহজ নয়, যতটা সহজ ভাবা হয়। 

নীল পাগল শব্দের উৎস সন্ধানের আগে ভেবে নেয়া ভালো, শিব বলতেই আমরা কিন্তু একা শিবকে মেনে নিতে পারি না। শিব মানেই পাবর্তী। যেখানে শিব, সেখানেই সতী। দুর্গার একনিষ্ঠ স্বামী। যুগল রূপে দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। এই যে যুগল রূপ, তা কিন্তু শেষ পযর্ন্ত টেকেনি। সতীকে নিয়ে দক্ষযজ্ঞ ঘটে গেল। একান্ন পিঠের আবির্ভাব হলো। তবে কী শিব একা হয়ে গেল! তবে যে আমরা আদর্শ দম্পতির কথা বলি, তা কী শুধুই কথার কথা! যে কোন নারীর আরাধ্য- শিবের মতো স্বামী, তাও কী শুধু লোক দেখানো!
না, মোটেই তা নয়! শিবের জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছেন আরেক সতী। যিনি দুর্গারই প্রতিরূপ। 

 


বলে নেয়া ভালো আমাদের গ্রাহাস্থ্য জীবনে যে ক’জন লোকদেবতা আছেন, তাদের শীর্ষে আছেন মহামহিম শিব। এক শিবকে নিয়ে যত লোককথা প্রচলিত আছে, তা একজন মানুষের সারা জীবনে সংগ্রহ এবং গ্রন্থিত করা সম্ভব নয়। আর গ্রন্থিত করা গেলেও তা মহাভারতকে ছাড়িয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।   
এমনই এক লোককথার মতে, শিবজায়া সতী পরবর্তী জন্মে আবির্ভূতা হন নীলাবতী নামে। দক্ষযজ্ঞে সতীর মৃত্যুর পরে একদিন নীলধ্বজ রাজা তার বাগানে বেল গাছের তলায় এক অপরূপ সুন্দরী কন্যা সন্তান দেখতে পান। রাজা বুঝতে পারেন, এই মেয়েই আসলে দেবী সতী! তাকে নিজের মেয়ের মতো করে বড় করে তোলেন রাজা। পরে শিবের সঙ্গে বিয়ে হয় নীলাবতীর। এই বিয়ের ঘটকালী করেছিলেন স্বয়ং নারদ।


এখানেই সতীর পুনর্জন্মে পার্বতী হয়ে জন্ম নিয়ে শিবের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পৌরাণিক আখ্যান আলাদা হয়ে গিয়েছে বাংলার লোককাহিনি। কিন্তু এর পরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। নীলাবতীই কি দেবী ষষ্ঠী? না হলে এই দিনটাকে নীল ষষ্ঠী বলা হবে কেন? অনেকের মতে, আসলে ষষ্ঠীই এসেছিলেন নীলাবতী রূপে। ষষ্ঠীর উল্লেখ কিন্তু পুরাণে পাওয়া যায়। তিনি আদি শক্তির অংশ, তাই তাঁকে দুর্গা বা আদ্যাশক্তির একটি রূপ হিসেবেই ধরা হয়। সুতরাং নীলাবতী একই সঙ্গে সতী অথবা ষষ্ঠী দু’জনেরই রূপ হিসেবে কল্পিত হতে পারেন। প্রধানত সন্তানের কল্যাণের জন্যই ষষ্ঠীর পূজা প্রচলিত বাংলা বিহার ওডিশা এবং উত্তর প্রদেশের কিছু জায়গায়।
নীলপূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য আচার। আর এসব আচার নীলপূজার সঙ্গে লোক সংস্কৃতির যোগ প্রমাণ করে দেয়।
নীলষষ্ঠী কেন্দ্র করে বাংলায় প্রচলিত রয়েছে বহু লোকগান। সুন্দরবন এলাকার বালা গান কিংবা অন্য অনেক জেলায় প্রচলিত অষ্টক গান নীলাবতী আর শিবের বিয়েকে ছন্দে বেঁধেছে। যা বাংলার একান্তই নিজস্ব এক সংস্কৃতি।

 


নীলপূজা কিন্তু সাদামাটা কোন পূজা নয়। পুরো চৈত্র মাস সন্ন্যাস ব্রত ধারণ করে তবেই সংক্রান্তির তিন দিন ধরে পূজার আয়োজন করা হয়। ওই যে গাজন বা চড়ক পূজা বলা হয়, তাও ভিন্ন কিছু নয়। সবই শিবের পূজা। চৈত্রের শেষ তিন দিন হয় মূল পূজা। প্রথম দিনে গিরিসন্ন্যাস, দ্বিতীয় দিনে হাজরা ও শেষ দিনে নীলসাঙ্গ। 
এবার এক দুই লাইনে জেনে নেয়া যাক, কেন নীল পাগল বলা হয়। মূলত দক্ষযজ্ঞে দেবীর প্রাণ বিসর্জনের পর থেকে শিবের যে উন্মাদনা রূপ, প্রিয়তমা হারানোর বেদনায় বিধ্বংসী, সেটাই নীল পাগলের সাজে প্রকাশ করা হয়েছে। শিবের আরেক নাম যে নীলকন্ঠ, তা আগেই জানা হয়েছে। সাগর মন্হনে উঠে আসা বিষ নিজ কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন বলেই নীলকন্ঠ নাম। 
 

এই যে দিনের পর দিন। পুরো মাস নীল পাগল সেজে দলবল নিয়ে গাঁয়ের পথে ঘুরে বেড়ানো, বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করা, গান গাওয়া, সবকিছুর মাঝেই রয়েছে গভীর পবিত্র আধ্যাত্ববোধ। গাঁয়ের মানুষ বিশ্বাস করে, নীল পূজায় আসে পুণ্য। আসে সুফল। পরিবার দেশ জাতি। সবার জন্য বয়ে আনে মঙ্গল। দলের সঙ্গে ঘুরে বেরিয়ে দেখা সম্ভব না হলেও শেষ তিন দিন কাছ থেকে নীল পাগলের দল দেখা যেতেই পারে। তবেই নীল পাগল নিয়ে কেন গাঁয়ের মানুষের এত উন্মাদনা, এত ভক্তি তার কিছুটা হলেও আঁচ পাওয়া যেতে পারে।

 

নীল পূজা মূলত শিবের সঙ্গে নীলাবতীর বিয়ের পূজা। যারা নীল পাগলের দল নিয়ে বের হন, তারা কিন্তু পুরো চৈত্র মাস সন্ন্যাস ব্রত ধারণ করেন। সারাদিন কাটে উপোস কিংবা ফলাহারে। সংক্রান্তির তিন দিন ধরে পূজা অর্থাৎ বিয়ের আয়োজন করা হয়। শ্মশানচারী শিবের বিয়ে বলে কথা। আয়োজনের কোথাও কমতি নেই।
আপনি যদি বরিশাল অঞ্চলের অধিবাসী  হয়ে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই নীল পাগল দলের সেই অতিপরিচিত গানটি শুনেছেন। যেখানে বলা হয়েছে-
‘শিব চইলাছে বিয়ার সাজে, নারদ বাজায় বীনা---’
সব সখীরা দ্যাখতে আইছে বিয়ার কথা শুইন্যা----’
ভিখ মাগার জন্য যে বাড়িতেই নীল পাগলদলের পর্দাপন হয়, সেখানেই কোরাস কণ্ঠে চলে এই গান। তিনদিনের বিয়ের আয়োজনে অধিবাস, বাসররাত, বাসিবিয়ে, ফুলশয্যা সবই করা হয়। বিয়ের পাত্রী কিন্তু সেই নীলাবতী। যিনি পাবর্তী রূপে ধরা দিয়েছেন শিবের কাছে। এজন্যই তো বলা হয় শিব-পাবর্তী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদর্শ দম্পতি। আরেকটু না বললেই নয়, হর-পাবর্তীর বিয়ে হয়েছিলে শিব রাত্রিতে। আর শিব-নীলাবতীর বিয়ে চৈত্র সংক্রান্তিতে। শেষ চৈত্রের কঠোর গরমে প্রান্তজনরা এভাবেই শিবের প্রশস্তি গেয়ে উৎসব আয়োজনে মেতে ওঠেন।  

 

 

উল্লেখ করা যেতে পারে, পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার গোলখালী গ্রামের নিখিল মেস্তুরীর নীল পাগলের দলের সদস্যসহ বিভিন্ন স্তরের কয়েকজন প্রবীণের সঙ্গে কথা বলে এই  নিবন্ধ তৈরি করা হয়েছে। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। এছাড়া আরও কিছু গ্রন্হ থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে। 

আঁখি

×