
বগুড়ায় ইটভাঁটি শ্রমিক আরিফুল নিজ নকশায় তৈরি করছেন হেলিকপ্টার। আকাশে ওড়ার অপেক্ষা
স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। ছোটবেলা কেটেছে এ বাড়ি ও বাড়িতে ফরমায়েশ খেটে। মাকে হারিয়েছিলেন সেই শিশু বয়সে। মায়ের মুখচ্ছবির মতোই বুক পকেটে আগলে রেখেছিলেন স্বপ্নগুলো। খেলনা তেমন ছিল না। যা কিছু হাতের কাছে পেয়েছেন তাই তার কাছে হয়ে ওঠে খেলার সামগ্রী। লোহালক্কড় ও বিয়ারিং পেনিয়ামের সঙ্গে এভাবেই পরিচয়। আর এসবের মাধ্যমেই দিনমজুর আরিফুলের স্বপ্ন তৈরি হতে থাকে। এক সময় স্বপ্ন ডানা মেলার দুঃসাহস দেখায়। স্বপ্নকে বুক পকেটে জমিয়ে রাখা বগুড়ার ইটভাঁটি শ্রমিক আরিফুল এখন হেলিকপ্টার তৈরি করেছেন। তবে কোনো খেলনা নয়, নিজের নকশায় ধাতব ফ্রেমে ইঞ্জিন বসিয়ে বড় আকৃতির হেলিকপ্টার তৈরির কাজ এখন শেষের পথে। পাখাও তৈরি করেছেন স্টিলের শিট ও অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে। এখন তার স্বপ্ন ডানা মেলার অপেক্ষায়। দিনমজুর আরিফুলের হেলিকপ্টার বানানোর খবরে সাড়া ফেলেছে চারদিকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই গ্রামে এখন আশপাশের গ্রামসহ শহর থেকেও উৎসুক মানুষের ঢল নামছে। সবাই দেখতে চান ইটভাটি শ্রমিক কি ভাবে আস্ত একটি হেলিকপ্টার তৈরি করছেন।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক ইউনিয়নে মাটিয়ান গ্রামে আরিফুলের বাড়ি শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। ফসলি জমি আর এঁকেবেঁকে চলা পথ ধরে তার বাড়ি। শহর থেকে সেখানে যেতে তেমন বেগ পেতে না হলেও আরিফুলকে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জীবন সংগ্রামের পথে লড়াই করতে পা বাড়াতে হয়। রোদ-বৃষ্টি সব কিছু উপেক্ষা করে পৌঁছাতে হয় কর্মস্থলে। কর্মস্থল মানে খোলা প্রান্তরে ইটভাঁটির চুল্লিতে কাঁচা ইট লোড দেওয়া। আর এই সংগ্রামের পথে সযত্নে আগলে রাখেন তার স্বপ্ন। গ্রীষ্মের দহন আর দমকা ঝড়ো হাওয়া অথবা বৃষ্টি তার স্বপ্নকে ভিজিয়ে উড়িয়ে নিতে না পারেন এ জন্য সতর্কতা যেন সব সময় তার।
স্বপ্নটা শুরু হয়েছিল তার মায়ের কোলে গল্প শুনতে শুনতে। মা রূপকথার গল্প শোনাতে গিয়ে উড়ে যাওয়া কথা বলতেন। আর পাখির ওড়াও আরিফুলের ভালো লাগে। মা মারা যান মাত্র ৯ বছর বয়সে। এরপর তাকে গল্প শোনানোর কেউ না থকেলেও আকাশে ওড়ার স্বপ্ন বুকের কোনায় জমতে থাকে ঠিকই। দরিদ্র পরিবারে খেলার কিছু ছিল না। তাই কচুগাছের গোড়া কেটে গোল আকৃতির চাকা বানিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলনা বানিয়ে নিজে নিজে প্রায় একাই খেলতেন। তবে আরিফুলের শৈশবের খেলার সময় কখনো দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। দরিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে ছোট বেলা থেকেই এ বাড়ি সে বাড়িতে কাজ করতে হতো। বুক পকেটে স্বপ্ন জমানোর মতোই আরিফুল ছোটবেলা থেকেই যন্ত্রাংশের প্রতি আগ্রহ। শৈশবের বন্ধু অটোরিক্সা চালক আমিরুলের উৎসাহে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেন। তবে টাকা কোত্থেকে আসবে। ইটভাঁটি মৌসুমে ইটভাঁটিতে কাজ শেষে বছরের অন্য সময় রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ, কখানো বা অটোরিক্সা চালান আরিফুল। দিনমজুরের আয় তো সব মিলিয়ে ৫/৬ শত টাকার মতো। এরই মাঝে বিয়ে করেছেন। স্ত্রী সালমা ও এক মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে তার সংসার। মেয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। সংসারে আয় না থাকলেও হেলিকপ্টার বানানোর স্বপ্ন আরিফুলকে কখনো ছাড়েনি। জানালেন ২০১৮ সাল থেকে এটি তৈরিতে হাত দেন। বিভিন্ন এনজিও ও ব্যক্তি থেকে কিস্তিতে টাকা ঋন নিয়ে কাজ শুরু করেন। একে তো সংসার চলে না তার ওপরে হেলিকপ্টার বানানোর জন্য ঋণ, স্ত্রী সালমার কাছে অনেকটা গরিবের ঘোড়া রোগের মতো। তাই মাঝে মাঝেই রাগ করে পিতার বাড়িতে চলে যান বলে জানান প্রতিবেশী শায়না বেগম। আরিফুল জানান এ পর্যন্ত হেলিকপ্টার তৈরিতে তার ২ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। চার বছর ধরে শুধু ছোট ধরনের যন্ত্রপাতি (আরিফুলের ভাষায় হ্যাতারপাতি) কিনেছেন। আগে প্রটোটাইপ তৈরি করেছেন ছোট আকারে। দেখেছেন তৈরি করা সম্ভব কি না। তার পর হাত দিয়েছেন হেলিকপ্টার তৈরীতে। প্রটোটাইপ তৈরী করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন দিনমজুর আরিফুলের বিশ্বাস জন্মে ছোট বেলায় মায়ের কোলে আকাশে ওড়বার যে গল্প শুনেছেন তা বাস্তবায়ন সম্ভব। যন্ত্রপাতি কেনার পর গত দেড় বছর ধরে প্রতিদিন ৩/৪ ঘণ্টা কাজ করছেন নিজের বানানো গুদামের মতো টিনের চাল দিয়ে ঘেরা ওয়ার্কশপে। আরিফুলের বাড়িতে এখন প্রতিদিন উৎসুক মানুষদের ভিড়। পাশের গ্রাম থেকে শুরু করে দূরের এলাকা থেকেও লোকজন ছুটে আসছেন টিনের ঘরে তৈরি হেলিকপ্টার দেখার জন্য। প্রায় ২ কিলোমিটার দুরের গ্রাম চল্লিশছত্র থেকে ফরিদা বেগমসহ ৪ জন এসছেন। আরিফুলের নিজ গ্রামের সাবেক ইউপি মেম্বার লুৎফর ও রহমান ও সোলায়মান আলী ভিড় ঠেলে দেখার চেস্টা করেছেন হেলিকপ্টার। জানালেন আগে কোন দিন হেলিকপ্টার দেখেনিনি। নিজ গাঁয়ের আরিফুলের তৈরি হেলিকপ্টার দেখতে এসেছেন। জানালেন আরিফুল এখন তাদের গ্রামের জন্য গর্ব হয়ে উঠেছেন। উল্লেখ্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যে হেলিকপ্টার তৈরির বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ায় এ নিয়ে গোটা শিবগঞ্জ উপজেলায় আলোড়ন। প্রতিদিন ভিড় সামলাতে হেলিকপ্টার তৈরির কারিগর দিনমজুরের পরিবারকে অন্যরকম অভিজ্ঞতায় পড়তে হচ্ছে। তার পরেও পরিবারের সদস্য এটি মেনে নিয়েছেন যদি ভালো কিছু হয়।
প্রতিদিন ভোরে আরফিুল ৮ কিলোমিটার দূরে ইটভাঁটিতে যান কাজ করতে। তপ্ত প্রখর রোদে পুড়ে কাজ শেষ হতে বেলা গড়িয়ে যায় তার। এর পর বাসায় এসে কোনো মতো মুখে কিছু ভাত গুঁজে দিয়েই নেমে চলে যান নিজের ওয়ার্কশপে। টিনের চালের এক ঘরের বাড়ি আরিফুলের। তার এক অংশে টিন দিয়ে ঘিরে বানিয়েছেন ওয়ার্কশপ। নানা যন্ত্রাংশ ছাড়াও সাংসারিক জিনিসপত্র সেখানে। হেলিকপ্টার বানানোর জন্য অনেকটা বিমান রাখার হ্যাঙ্গারের মতো টিনের ছাদ উচু করে একাংশ আবার খোলা রেখেছেন। আরিফুলের হেলিকপ্টারটি এ্যালুমিনিয়াম, জিআই পাইপ, স্টিলের পাত, ও নানা ধরনের পিনিয়াম, বিয়ারিং ও শ্যাফট দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এর দৈর্ঘ্য ১২ ফুট। এতে সাড়ে ৫ ফুট লম্বা ৪টি পাখা (রোটার ব্লেড) ব্যবহার করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। মোটরাসাইলের ইঞ্জিনের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যাটারি। প্রাথমিকভাবে পাখা ছাড়া এটির ফাংশন পরীক্ষায় সফল হয়েছে বলে জানিয়েছে আরিফুল। তার আশা আর ১৫ দিনের মধ্যেই তিনি স্বপ্নের হেলিকপ্টারের কাজ শেষ করতে পারবেন। আশা করছেন সামনে জ্যৈষ্ঠ মাসে ধান কাটা শেষ হলে খোলা মাঠে এটি ওড়াবেন। এটিতে এক জনই বসতে পারবেন। এর ওজন ১৩০ কেজি। আরিফুলের আশা হেলিকপ্টারটি নিজের ওজনসহ সব মিলিয়ে ৩০০ কেজি ওজন নিয়ে উড়তে পারবে। উড়ানোর পর সব যদি ঠিক এটি নিয়ে আরও কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে। হেলিকপ্টারের কারিগর ইটভাঁটি শ্রমিক দিনমজুর আরিফুলের আশা এটি সফল হবেই। এটি সফল হলে গোটা দেশের মধ্যে বগুড়ার নাম ছড়িয়ে পড়বে এই স্বপ্ন এখন তার সামনে। আর হেলিকপ্টারের ডানার সঙ্গে তার স্বপ্নও পাখা মিলবে ঠিক মায়ের কোলো শোনা রূপকথার গল্পে উড়ে যাওয়ার মতো। তবে আর্থিক অসঙ্গতি তার সফলতার পথে বাধা হয়ে রয়েছে। হেলিকপ্টার তৈরির বিষয়ে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জানান তিনি বিষয়টি জানেন। এটি উড্ডয়ন হওয়ার পর সহযোগিতা চাইলে উপজেলা প্রশাসন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। এখন বিষয়টি তাদের নজরে রয়েছে বলে জানান।
প্যানেল