
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন এবং ঠাকুরবাড়ি বাঙালি সংস্কৃতির বড় ধারক। ঠাকুরবাড়িতে বৈশাখ উদযাপন ছিল খুবই শালীন, নান্দনিক এবং শিল্পঘেঁষা। এখানকার ফ্যাশন ছিল চিন্তাধারার এক প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন ফ্যাশনের একজন ধারক। তিনি মানতেন ফ্যাশন মানে শুধু বাহ্যিক সাজ নয় বরং তা শিল্পচর্চা ও রুচির প্রতিফলন। তাঁর কবিতায় এবং সংগীতে নববর্ষের রুচিশীল উদযাপন ফুটে উঠেছে বহুবার।
মেয়েরা পরতেন হালকা রঙের সাদা বা অফ-হোয়াইট মসলিন বা তাঁতের শাড়ি সঙ্গে লাল পাড় আজও বৈশাখের প্রতীক হয়ে আছে। হাতে শাঁখা-পলা, কপালে টিপ এবং চুলে গাঁদা ফুল বা রজনীগন্ধার গুচ্ছ। রং হতো সাধারণত লাল, সাদা বা ধুতি রঙের ছোপে ছোপে কাঠামো গাঁথা। অলঙ্কার ছিল সোনালি বা কাচের, কিন্তু কখনোই অত্যধিক নয়। নারীরা শাড়িতে থাকতেন ঐতিহ্যবাহী সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ।
পুরুষেরা পরতেন ধুতি-পাঞ্জাবি। মাথায় থাকতো ‘পাগড়ি’ বা ‘টুপি’। ধুতিতে জড়ানো ছিল এক ধরনের শিল্প। এরপরে ধীরে ধীরে ফ্যাশনে আসতে থাকে হালকা মসলিন বা খাদি কাপড়ের পাঞ্জাবি, মাঝে মাঝে পকেট ঘেঁষে একটা গোলচিহ্ন বা কারুকার্য থাকত। মাথায় থাকত টুপি বা চাদর। রবীন্দ্রনাথ নিজেও পোশাকে ছিলেন সরলতায় পরিপূর্ণ। তবে গাম্ভীর্য ও রুচিশীলতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
বৈশাখী ফ্যাশনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা
যদিও লোকাচার হিসেবে বৈশাখী ফ্যাশনের প্রচলন বহু পুরোনো, কিন্তু এটাকে একটি ‘ফ্যাশন ট্রেন্ড’ হিসেবে দেখা যায় গত শতাব্দীর শেষভাগে এসে, বিশেষ করে ১৯৮০ ও ৯০ দশকে। এই সময়েই বাংলা নববর্ষকে ঘিরে শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে একটি সাংস্কৃতিক নবজাগরণ দেখা যায়। ছায়ানটের রমনার বটমূলে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান বৈশাখকে ঘিরে একটি জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়। এই সময় থেকেই পোশাকেও আসে এক রঙিন পরিবর্তন।
নববর্ষ মানেই আজকাল লাল-সাদা অথবা কমলা-হলুদের সংমিশ্রণ। শহরাঞ্চলে নতুন জামাকাপড় পরার একটি আলাদা উৎসবমুখরতা তৈরি হয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস যেমন দেশাল, আড়ং, বাউল, রঙ ইত্যাদি পহেলা বৈশাখের জন্য আলাদা কালেকশন তৈরি করা শুরু করে। এর ফলে বৈশাখী ফ্যাশন হয়ে ওঠে একটি বাণিজ্যিক উৎসবও।
আজকাল শুধু শাড়ি বা পাঞ্জাবিতেই সীমাবদ্ধ নয়, যুক্ত হয়েছে ফিউশন ড্রেস। লং কুর্তি, পালাজ্জো, আনারকলি, টপ-স্কার্ট, ট্র্যাডিশনাল জ্যাকেট ইত্যাদি। ছেলেরা পরে ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি, জিন্স বা কটি-পাঞ্জাবির কম্বিনেশন। ছোটদের জন্যও আছে রঙিন ফ্রক, শার্ট, ছোট পাঞ্জাবি।
পহেলা বৈশাখের ফ্যাশনে যেসব পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আগে ছিল সাদামাটা তাঁতের শাড়ি, ধুতি-পাঞ্জাবি আর বর্তমানে চলছে বুটিক শাড়ি, ডিজাইনার পাঞ্জাবি, ফিউশন ড্রেস। আবার একসময় নারীরা গহনার ক্ষেত্রে শুধু সোনা বা ফুলের গয়না পরত। আর আধুনিক ফ্যাশনে টেরাকোটা, কাঠের গয়না ও নান্দনিক জুয়েলারিতে নজর কাড়ে সবার। সাজসজ্জায়ও এসেছে আমূল পরিবর্তন। হালকা মেকআপ, ফুল দিয়ে চুল বাঁধার জায়গায় এসেছে মেকআপের আধুনিকতা, হেয়ার স্টাইলিংয়ে রঙের ব্যবহার প্রধানত লাল-সাদা, হলুদ, নীল ও সবুজসহ নানা রঙের বৈচিত্র্য। ফ্যাশনের পাশাপাশি সাজসজ্জায়ও এসেছে বেশ পরিবর্তন। আগে যেখানে মুখে হালকা মেকআপ, কপালে বড় টিপ, আর ফুল দিয়েই সীমাবদ্ধ ছিল সাজ, এখন সেখানে যুক্ত হয়েছে চুলে স্টাইল, হেয়ার কালার, ব্লাশ, হাইলাইটার, নানা ধরনের ব্র্যান্ডেড মেকআপ সামগ্রী। হাল ফ্যাশনে মেয়েরা ঝুঁকেছে কস্টিউম জুয়েলারিতে। টেরাকোটা, কাঠের তৈরি গহনা, বুটিক ব্যাগ ও এক্সেসরিজে তৈরি হয়েছে দারুণ চাহিদা। পুরুষদের মধ্যে এখন দাড়ি-গোঁফ রাখা, কটি জ্যাকেট, চোখে সানগ্লাসসহ দেখা যায় নানা ধরনের আধুনিকতার ছোঁয়া। ফ্যাশনের মধ্য দিয়েই মানুষ যেন নিজের ঐতিহ্য, শিল্পবোধ ও আনন্দকে উদযাপন করে। ‘মাটির পুতুল’, ‘ঘোড়া’, ‘ময়ূর’ প্রভৃতি লোকজ মোটিফ ঠাঁই পেয়েছে ফ্যাশনে। ডিজাইনাররা এখন এসব মোটিফ ব্যবহার তৈরি করছেন নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক।
ফ্যাশনের এই পরিবর্তন নিছক বাহ্যিক রূপান্তর নয়, বরং তা সমাজের চিন্তা-ভাবনারও প্রতিফলন। আজকের বৈশাখী ফ্যাশনে যেমন রয়েছে বাঙালিত্বের গর্ব, তেমনি রয়েছে বৈশ্বিক আধুনিকতার ছোঁয়া। তবে এই পরিবর্তনের মধ্যেও একটা বিষয় অপরিবর্তিত থেকেছে। নববর্ষ মানেই নতুন পোশাকে নিজেকে সাজানো, পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং আনন্দে মেতে ওঠা।
বৈশাখী উৎসব শুধু ক্যালেন্ডারের একটি দিন নয়। এটি বাঙালির আত্মপরিচয়েরও প্রতীক। উৎসবের রং, সাজ-গোজ, পোশাক সব কিছু মিলেই এটি হয়ে উঠেছে জাতিসত্তার প্রতিচ্ছবি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাশন বদলেছে, কিন্তু মূল চেতনা রয়ে গেছে একই। নববর্ষে নতুন করে জীবনকে গ্রহণ করা এবং রঙিন করে তোলা হয় নিজের চারপাশকে। জীবন-জীবিকা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রকৃতিনির্ভর বাঙালি সংস্কৃতিচেতনার রূপায়ণ যেভাবে ঘটেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়।
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।