ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

বিভিন্ন উৎসবে ব্যাপক চাহিদা

বাহারি কাগজের ফুল তৈরি করে অনেকে স্বাবলম্বী

বিশ্বজিৎ মনি

প্রকাশিত: ২৩:০১, ১১ এপ্রিল ২০২৫

বাহারি কাগজের ফুল তৈরি করে অনেকে স্বাবলম্বী

.

একদিন পরই বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবে  বৈশাখী মেলা। তবে কাগজের বাহারি ফুল ছাড়া যেন পূর্ণতা পায় না এসব মেলা। প্রিয়জনকে উপহার কিংবা বাচ্চাদের খেলনা, কাগজের ফুলের যেন তুলনা নেই। তাই এই ফুলের জোগান দিতে দিনরাত বিভিন্ন রঙের বাহারি কাগজ, কাপড় ও শোলা দিয়ে তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নওগাঁর আত্রাইয়ের জামগ্রামের ফুল কারিগররা। বৈশাখ সামনে রেখে জামগ্রামের ফুলের কারিগররা স্টার, চর্কি, মানিক  চাঁদ, গোলাপ, সূর্যমুখী, কিরণমালা, জবা, বিস্কুট, গাঁদাসহ বিভিন্ন নামের বাহারি নাম আর ডিজাইনে ফুল তৈরি করছেন। যেন দেখে মনে হবে এক একটা জীবন্ত ফুল।
প্রায় ৪০ বছর আগে ওই গ্রামের ২-৩টি হিন্দু পরিবার এই ফুল তৈরির কাজ শুরু করেন। এখন তাদের হাত ধরে পুরো গ্রামের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস এই ফুল তৈরি। ওই গ্রামের প্রায় ৪শ’ পরিবার এখন এই বাহারি ফুল তৈরির কাজ করে। সংসার দেখভাল করার পাশাপাশি গ্রামের নারী-পুরুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, ছোট-বড় সবাই এই ফুল তৈরি করার কাজ করে থাকেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবে বৈশাখী মেলা আর এই মেলাগুলোকে আরও বর্ণিল সাজে সাজাতে তাদের এই প্রাণান্ত চেষ্টা। পাশাপাশি স্বাবলম্বী হচ্ছেন ফুল কারিগররা। তাই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে রাত অবধি কাজ করেন কারিগররা। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে বিভিন্ন স্থানে জটলা বেঁধে কয়েকজন মিলে তৈরি করছে এই ফুল।  ফুল তৈরির পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। তবে পহেলা বৈশাখে এই ফুলের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। তবে দুই ঈদ, বিভিন্ন পূজা ও মেলায়ও এই ফুল বিক্রি হয়। কেউ কাপড়, কাগজ আর বাঁশসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সকাল থেকে রাত অবধি ফুল তৈরির কাজ করে চলেছেন। পরিবারের একজন নয়, ফুল তৈরির এ কাজ করছেন প্রায় সকলেই। বিশেষ করে নারীরা সংসারের কাজ-কর্ম সেরে তৈরি করছেন ফুল। খুব বেশি পরিশ্রম না হলেও ধৈর্যসহকারে করতে হয় কাজগুলো। বাড়ির সকলে মিলে ফুল তৈরির পর পুরুষরা বিক্রির উদ্দেশ্যে চলে যায় জেলা ও জেলার বাইরে। অর্থাৎ দেশের ৬৪ জেলায়। সেখানে গিয়ে তারা ১৫-২০ দিন পর্যন্ত অবস্থান করে ফুলগুলো বিক্রি শেষ করে পুনরায় বাড়ি ফেরেন। এতে বার্ষিক একটি বড় অঙ্কের আয়ও করে থাকেন তারা।
জামগ্রামের ফুল কারিগর সুরুজ ইসলাম দুলু বলেন, প্রথমে আমার দাদা, এর পর আমার বাবা। তারা গত হওয়ার পর আমিও দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এই ব্যবসা করছি। এসব ফুল তৈরির উপকরণ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আমদানি করা হয়। তার পর সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে ফুলে রূপান্তরিত করা হয়। এই ফুল তৈরির কাজে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান সহযোগিতা করেন।  
পহেলা বৈশাখ আসার এক মাস আগে থেকে শুরু হয় ফুল তৈরির কাজ। ওই গ্রামের ফুল কারিগর মনিরুল ইসলাম কানন বলেন, তার বাবা এই ফুল তৈরি ও তৈরিকৃত ফুল বিভিন্ন জেলায় পাইকারি বিক্রির কাজ করতেন। সেই সুবাদে তিনিও এ কাজ করছেন। বর্তমানে তিনি, তার স্ত্রী, দুই সন্তান ও বাবা-মা যৌথভাবে সংসার করছেন। তবে এই ফুল তৈরি থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে অনেক সচ্ছলভাবেই দিন কেটে যায় তাদের। তারা সারা বছর এ কাজ করে থাকেন। ৫৫ বছর বয়সী আমিনুল ইসলাম বুলু নামে এক ফুল ব্যবসায়ী জানান, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তিনি এই ফুল বিক্রির সঙ্গে জড়িত। ফুলগুলো পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলাগুলোতে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। যে এলাকায় যাওয়া হয় সেখানে তাঁবু খাটিয়ে নিজেরাই রান্না-বান্না করে খেতে হয়। এতে করে পহেলা বৈশাখ, দূর্গাপূজাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মৌসুমভেদে লাভ হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ফুলের কারিগর আফরোজা বানু বলেন, ফুল তৈরিতে পরিবারের গৃহিণীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। সংসারের সব কাজ সম্পন্ন করে পরিবারের পুরুষদের এই ফুল তৈরিতে সাহায্য করে। তিনি আরও বলেন, সরকার থেকে বিনা অথবা স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে আমাদের এ শিল্পটি আরও এগিয়ে যাবে। আত্রাই মোল্লা আজাদ সরকারি কলেজে পড়–য়া শিক্ষার্থী পূজা বলেন, বাবা এই ফুলের ব্যবসা করে আমাদের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন। আমিও পড়ালেখার পাশাপাশি ফুলের কাজ করে পরিবারকে সাহায্য করে থাকি। এতে করে আমার হাত খরচ চলে যায়।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, এটি একটি ঐতিহ্যপূর্ণ শিল্প। যার কদর দেশজুড়ে। শৌখিন মানুষ ও শিশুদের কাছে এই বাহারি কৃত্রিম ফুলগুলোর চাহিদা অনেক বেশি।
ফুল কারিগররা শুধু তাদের উপার্জনই নয়; বাংলার সকল সাংস্কৃতিক উৎসবকে বর্ণিল করতেও বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছেন। এটা একটি ক্ষুদ্র কুটির শিল্প। আর এই শিল্পের তৈরি ফুলগুলো দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিক্রি হচ্ছে। শুধু পহেলা বৈশাখ নয়, বিভিন্ন গ্রামীণ মেলার সোন্দর্যবর্ধনে ব্যপক ভূমিকা রাখে এই জামগ্রামের ফুল। এর সঙ্গে জড়িত কারিগরদের জন্য উন্নতমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাসহ স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করার আশ্বাস প্রদান করেন।

×