ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১

ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা

ক্ষমতা ও শৌর্যের প্রতীক আত্মরক্ষার রণকৌশল লোকসংস্কৃতি

রফিকুল ইসলাম রনি

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ৬ এপ্রিল ২০২৫

ক্ষমতা ও শৌর্যের প্রতীক আত্মরক্ষার রণকৌশল লোকসংস্কৃতি

.

চিরায়ত আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন খেলা ‘লাঠিখেলা’। এটি বাংলার লোকজ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শরীর চর্চা, বিনোদনের পাশাপাশি এই খেলা ছিল ক্ষমতা ও শৌর্যের প্রতীক। নিয়মিত চর্চার পাশাপাশি এক সময় খেলাটি বর্ষবরণ, পূজা-পার্বণসহ নানা উৎসবে বড় পরিসরে আয়োজন করা হতো। তখন খুব জনপ্রিয় ছিল এই খেলা। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় খেলোয়াড়দের দলনেতার উদ্যোগে গড়ে উঠত লাঠি খেলার দল। আর পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে অনুষ্ঠিত হতো এই খেলা। অথচ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে এই লাঠিখেলা। 
লাঠিয়ালের পরনে বাহারি পোশাক আর হাতে লাঠি। লাঠি ঘুরছে শাঁই-শাঁই, পন-পন। ঢাক ঢোল, ঝুমঝুমি, কাঁসর ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে নাচ ও লাঠির কসরত। লাঠি দিয়ে সড়কি, বানুটি, বাওই জাক, নড়ি-বাড়িসহ নানা লাঠিখেলা। খেলোয়াড়রা তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন ও আত্মরক্ষা করে। ইতিহাস থেকে জানা যায় ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলার জমিদাররা তাদের নিরাপত্তার জন্য লাঠিয়ালদের নিযুক্ত করতেন। 
গ্রামের মানুষ নিজেদের নিত্যদিনের কাজ দ্রুত সমাপ্ত করে ছুটে যেত খেলা দেখার জন্য। বাড়ির আঙিনায় এই খেলা দেখার জন্য ঘরের চালে গাছের ডালে ভিড় জমাত যুবকরা আর বেড়ার ফাঁকে, জানালা খুলে খেলা দেখত মা-বোনরা। আর সে দিনের সেই কাঠের টুল আর পিঁড়ি পেড়ে বসে খেলা দেখত বৃদ্ধরা। দর্শকদের হাতে তালি আর মুখের জয়ধ্বনি খেলোয়াড়দের আনন্দ জোগাত। খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঢোল আর লাঠির তালে তালে নাচ, অন্যদিকে প্রতিপক্ষে লাঠির আঘাত হতে আত্মরক্ষার কৌশল অবলম্বনের প্রচেষ্টায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করত খেলোয়াড় ও দর্শকদের মাঝে। খেলা শুরুর দুদিন আগেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হতো কোন গ্রামের কোন মাঠে বা কার বাড়িতে কোন সময় এই খেলা অনুষ্ঠিত হবে। 
কিন্তু কালের আবর্তে আজ লাঠি খেলার সেই বিনোদন ভুলতে বসেছে দেশের মানুষ। বর্তমানে নতুন করে লাঠি খেলার কোনো সংগঠন বা দল  তৈরি হচ্ছে না। কালের আর্বতে সেই লাঠি খেলার স্থান আজ দখল করে নিয়েছে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাটমিন্টন। তা ছাড়া অতীতের খেলার পরিবর্তে মোবাইল ফোনে চলছে পাপজি, ফ্রিফায়ারসহ বিভিন্ন ধরনের খেলা। যেখানে ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যরা স্থান পেলেও গ্রাম-বাংলা দরিদ্র পরিবারের লোকরা আধুনিক যুগের খেলা দেখার জন্য ছুটে যায় প্রতিবেশীদের ঘরের টিভির কাছে, কিন্তু শত বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে গ্রাম-বাংলায় আজও কিছু কিছু জায়গায় চলে অতীতের সেই লাঠিখেলা। 
গ্রামীণ সেই ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালন করে ঈদ উপলক্ষে পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল সিদ্ধিনগর গ্রামে ও ভাঙ্গুড়ার অষ্টমনিষা গ্রামে বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।   
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শুক্রবার বিকেল ৫টায় অষ্টমনিষা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অষ্টমনিষা ইউনিয়ন কৃষকদলের উদ্যোগে ও ওই ইউনয়ন কৃষকদলের আহ্বায়ক মো. সেলিম রেজার সভাপতিত্বে লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বুধবার হান্ডিয়াল সিদ্ধিনগর বটতলা সবুজ চত্বরে গ্রামের যুবসমাজের উদ্যোগে ও হান্ডিয়াল ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সিনিয়রসহ সভাপতি মো. ইসাহক আলীর সভাপতিতে খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। 
 খেলায় বিভিন্ন গ্রামের বর্ষীয়ান লাঠিয়ালগণ অংশগ্রহণ করে খেলাটি প্রাণবন্ত করে তোলেন। গ্রামীণ ঐতিহ্য লাঠিখেলা দেখতে মানুষের ঢল নামে। জনসাধারণের ছিল এবারের ঈদের বিশেষ আকর্ষণ এই খেলা।
সিদ্ধিনগরে অনুষ্ঠিত খেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, পাবনা-৩ সাবেক সংসদ সদস্য কে এম আনোয়ারুল ইসলাম। ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। মধ্যযুগে লাঠি খেলা আরও জনপ্রিয় ছিল। বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে লাঠি খেলার আয়োজন করা হতো। গ্রামের মানুষ এ খেলা উপভোগ করত। আধুনিক যুগেও লাঠিখেলা তার জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছে। যদিও এর প্রচলন অনেকটাই কমেছে, তবু গ্রামীণ এলাকায় এটি এখনো খেলা হয়।  যুবসমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন রাখতে পারে কার্যকরী ভূমিকা। নিয়মিত এই ধরনের খেলার আয়োজন করার প্রত্যাশা করে বক্তব্য দেন প্রধান অতিথি। 
হান্ডিয়াল সিদ্ধিনগর গ্রামের লাঠি খেলোয়াড় সরোয়ার বলেন, এই খেলায় দশ বছর বয়সে নানার নিকট থেকে প্রথমে হাতেখড়ি। এ খেলা মনে প্রাণে ভালোবাসি। ৩০ বছর ধরে এই খেলায় নিয়োজিত রয়েছি। প্রায় ৮০টি পুরস্কার পেয়েছি। 
দরাপপুর গ্রামের সত্তোরোর্ধ্ব লাঠি খেলোয়াড় আবু ইউসুব বলেন, এই খেলার লাঠি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা হয়। তবে প্রতিটি লাঠি হয় প্রায়  তৈলাক্ত। প্রত্যেক খেলোয়াড় তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন করেন। খেলার স্থানে লাঠির পাশাপাশি যন্ত্র হিসেবে ঢাক, ঢোল, কনেট, ঝুনঝুনি ও বিভিন্ন প্রকার বাঁশি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া সঙ্গীতের পাশাপাশি এ খেলার সঙ্গে চুড়ি নৃত্যও দেখানো হতো। তিনি আরও বলেন, বারো বছর বয়সে বাবার নিকট থেকে শিক্ষা নিয়ে এই খেলা শুরু করেছি। খেলায় সফলতা হিসেবে  দুই শতাধিক পুরস্কার পেয়েছি। 
খেলা দেখতে আসা চাটমোহর টেকনিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রহিম কালু, তিনি বলেন, লাঠি খেলার ইতিহাস অনেক পুরোনো। এটি বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে যুক্ত। প্রাচীনকালে লাঠি খেলা ছিল গ্রাম্য বিনোদনের অন্যতম উপায়। এই খেলা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। প্রাচীনকালে লাঠি খেলা ছিল যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের একটি অংশ। এটি ছিল তাদের আত্মরক্ষার কৌশল। পরে এটি সাধারণ মানুষের বিনোদনের অংশ হয়ে ওঠে। 
হান্ডিয়াল রায়নগর গ্রামের মনিরুল, ভেংড়ি গ্রামের সাইফুল ও টিবাপাড়া গ্রামের আবুজল খেলোয়াররা বলেন, বাপ-দাদার সেই স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই আমরা এ খেলা ধারণ ও লালন করে আসছি। লাঠি খেলার গুরুত্ব অনেক। এটি শুধু বিনোদনের জন্য নয়, এর অনেক শারীরিক ও মানসিক উপকারও আছে। লাঠি খেলা শরীরকে ফিট রাখে। এটি হাত ও পায়ের শক্তি বাড়ায়। এ খেলা শরীরের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়। লাঠি খেলা মনকে সতেজ রাখে। এটি মনোযোগ বৃদ্ধি করে। লাঠি খেলা মানসিক চাপ কমায়। 
চাটমোহর উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের কুরবান আলী, কেশবপুর গ্রামের আবুল আকন্দ ও জয়ঘর গ্রামের রহিম লাঠিয়াল এ খেলার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, লাঠি খেলা কৌশলগত খেলা, সঠিক কৌশল না জানলে খেলা সম্ভব নয়। খেলোয়াড়দের কৌশল শিখতে হয়। খেলাটি দলবদ্ধভাবে খেলা হয়। এ খেলা থেকে দলবদ্ধতার শিক্ষা পাওয়া যায় এবং খেলোয়াড়দের একসঙ্গে কাজ করতে হয়। লাঠি খেলার প্রধান সরঞ্জাম হল লাঠি। লাঠি সাধারণত বাঁশ বা কাঠের  তৈরি হয়।  
সমাজসেবক ও শিক্ষক মো. আবু ছালেক বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ও অন্যান্য খেলাধুলার কারণে ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলার প্রচলন কমেছে। বর্তমানে লাঠি খেলা চ্যালেঞ্জিং অবস্থায় রয়েছে। লাঠি খেলার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকটাই আশা করা যায়। যদি সঠিক প্রচেষ্টা করা হয়, তবে এটি আবার জনপ্রিয় খেলা হিসেবে নিয়মিত চলতে পারে।
বিশিষ্ট সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ এম এ হান্নান খোকন বলেন, লাঠি খেলা বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ। এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি মূল্যবান ধন। আমাদের উচিত এই খেলা সংরক্ষণ করা। লাঠি খেলা গ্রামবাসীর জন্য আনন্দের উৎস। 

×