ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮ চৈত্র ১৪৩১

ঈদুল ফিতরে থাকবে না রাজা-প্রজা-ধনী গরিব ভেদাভেদ

ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ১৭:৫৫, ৩০ মার্চ ২০২৫

ঈদুল ফিতরে থাকবে না রাজা-প্রজা-ধনী গরিব ভেদাভেদ

ছবি: সংগৃহীত

ঈদ মোবারক। তাপসী, আছিয়া, ফিলিস্তিনের মুসলমান, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ পৃথিবীর নিষ্পেষিত, নির্যাতিত, অবহেলিত ও নিরন্ন মানুষগুলোকে উৎসর্গ করে এ লেখার অবতারণা করছি, যারা তুচ্ছ কারণে জর্জরিত, কেউ বা বিনা দোষে শকুনের রোষানলে পড়ে অকালে জীবন দিতে হয়েছে। তারা যেন না ফেরার দেশে ভালো থাকে।

ঈদ মানে খুশি বা আনন্দ। দুনিয়াজুড়ে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। বাংলাদেশের মুসলমানরা সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে বিবেচনা করেন ঈদুল ফিতরকে এবং এক কথায় সবার কাছে পরিচিত ঈদ হিসেবে।

ঈদ ইসলামের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলেও এই ধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু ঈদের প্রচলন শুরু হয়নি। ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে যে, ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ঈদ উদযাপন করা হয়েছিল। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা থেকে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরত করে মদিনায় যান, তখন সময়কে ভিত্তি ধরে হিজরি সাল গণনা করা হয়। এরপর হিজরি দ্বিতীয় সালে এসে বিধান দেওয়া হয় যে, রমজান মাস চাঁদের হিসাবে যা ২৯ দিনেও শেষ হতে পারে বা কখনো ৩০ দিনেও শেষ হতে পারে - শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদ উদযাপন করা হবে।

এ বিষয়ে আনাস নামে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন সাহাবা বা সাথীর বর্ণনা করা একটি হাদিসের উদ্ধৃতি অনুযায়ী, মদিনায় যাওয়ার পর নবী দেখলেন যে, সেখানকার মানুষ বছরে দুটি বড় উৎসব পালন করে। এগুলো ছিল নওরোজ এবং মিহিরজান নামে উৎসব- যেগুলো সেখানকার বাসিন্দাদের ধর্ম এবং গোত্রের রীতি অনুযায়ী একটি শরতে এবং আরেকটি বসন্তকালে উদযাপিত হতো।

ঈদ উদযাপন মদিনায় শুরু হলেও পরবর্তীতে পুরো দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রচলিত হয় ঈদ পালন। ইতিহাসবিদরা বলেছেন, দেড়শ বছর আগেও এ অঞ্চলে সাধারণের মধ্যে ঈদ তেমন বড় কোনো উৎসব ছিল না। তাদের মতে, ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজি শরীয়তুল্লাহর সময় বঙ্গে উৎসব করে ঈদ উদযাপনের চল শুরু হয়। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন এ অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন ঈদ পালনও বাড়তে থাকে বলে উল্লেখ করা হয় বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের লেখায়। এক সময় দিল্লির মুঘলদের অনুকরণে ঢাকায় ঈদের মিছিল হতো। ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমানে ঈদ যেমন ব্যাপক উৎসবের আকার পেয়েছে, তার শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পর - যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আস্তে আস্তে বিস্তৃত হতে থাকে। তার আগে, ঈদ উদযাপনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা। আনুষ্ঠানিকতার প্রায় পুরোটাই ছিল ঢাকা কেন্দ্রিক, যে কারণে ঐতিহাসিক বর্ণনায় ঢাকার ঈদ সম্পর্কেই জানা যায়।

আমাদের শিশুকাল ও বাল্যকালে ঈদ ও বর্তমান সময়ের ঈদের অনেক পার্থক্য রয়েছে। তখনকার ঈদ মানে ছিল দোকানে ঈদ কার্ডের পশরা। হরেক রকম ঈদ কার্ড ছিল, বিভিন্ন আকার আকৃতি ও দামের তফাৎ। তখন ঈদ মানেই ছিল মানুষে মানুষে মিলেমিশে একাকার। তখন ঈদ মানে ছিল গাছ হতে তাজা মেন্দি পাতা বেটে হাতে লাগানো। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিবের ঈদ মানে ছিল, দাগ পড়া জামা লন্ড্রির দোকানে ওয়াশ করা এবং আয়রন করে চকচকে বানানো, আরো ছিল আংশিক ছেঁড়া পাঠা জামা রিপু ও তালি দিয়ে জোড়া লাগানো। ঈদ মানে ছিল ডাক পিওনের ঈদ কার্ড ডেলিভারি দেওয়ার হাঁকডাক। গ্রামীণ জনপদে ঈদ উপলক্ষে মেলার আয়োজন খুবই আকর্ষণীয় ছিল। তখন ঈদ মানে ছিল সিনেমা হলে গিয়ে অন্তত একটি সিনেমা দেখা। ঈদ মানেই ছিল বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, খালা, ফুফু, মামি, চাচি ও বড় ভাইবোন হতে হরেক মূল্যমানের নতুন কচকচে নোট বকশিস পাওয়া। ঈদ মানে ছিল নিকট আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া।

এখন ঈদ মানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাহজাদী গোল্ড, বধুয়া, রূপসীসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কৃত্তিম মেহেদী হাতে লাগানো। কালের পরিক্রমায় অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় ঈদও হয়ে গেল ডিজিটাল। এখন ঈদ মানে হল ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ও এক্স এ শুভেচ্ছা জানানো। এখন ঈদ মানে হল বিকাশ, নগদসহ অন্যান্য মাধ্যমে ডিজিটাল বকশিস। এখন ঈদ মানে হল ইমু, মেসেঞ্জার ও জুমের মাধ্যমে কথোপকথন। এখন ঈদ মানে হল মোবাইল ফোনে সেলফি তোলার উৎসব। এখন ঈদ মানে হল সেলফোনে অনর্গল কথোপকথন। এখন ঈদ মানে হল গ্রাম, পাড়া, মহল্লায় বিশাল সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে ডিজে পার্টির আয়োজন। এখন ঈদ মানেই হলো মোবাইল ফোনে নাটক, সিনেমা ও বিভিন্ন কনটেন্ট দেখা।

এবার আমার বাল্যকালের ঈদুল ফিতর নিয়ে কিছু স্মৃতি রোমন্থন করা যাক। বাল্যকালে অন্যদের মতো, আমার বন্ধু ও সমবয়সী আত্মীয়-স্বজনরাও ঈদের নতুন জামা-কাপড় নিয়ে মেতে থাকত। আমি এর ব্যতিক্রম ছিলাম। আমার যত বায়না ছিল খেলাধুলার উপকরণ নিয়ে। আমার শ্রদ্ধেয় মরহুম বড় ভাই তখন ঢাকায় সরকারি চাকরি করত। বাবার অফিসের টেলিফোনে একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করল, এই ঈদে তোমার জন্য কি নিয়ে আসব। আমি বললাম, ফুটবল। হেসে জিজ্ঞেস করল, কি বল। আমি বললাম ডিয়ার বল। ওই সময় ডিয়ার লেখা ফুটবল খুব জনপ্রিয় ছিল। ঈদের দিন সকালে আমার কাক্সিক্ষত ফুটবলটি প্রথম শর্ট মারতেই মান্দার গাছের কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে পঙ্চার হয়ে বাতাস বের হয়ে গেল। আমাদের গ্রামে আঞ্চলিক ভাষায় এই কাঁটাযুক্ত গাছকে মান্দার গাছ বলা হয়। এবার আমি রেগে মেগে কেঁদে বলটি কেটে কয়েক টুকরো করে ফেললাম।

আমার কষ্ট এবং কান্না দেখে আশপাশের অনেকের ঈদ মাটি হয়ে গেল। অনেকে কান্না শুরু করল। কোনো এক অদৃশ্য কারণে হয়তো আমার পরিবার এবং পাড়া-প্রতিবেশী আমাকে একটু বেশি আদর করত। সেজন্য সবাই আমাকে নিয়ে মেতে থাকত, একের পর এক সবাই এসে সান্ত্বনা দিতে লাগল। আমি বিরক্ত হয়ে শীতকাল হওয়ায় কম্বল মুড়ি দিয়ে সে কি ঘুম। বাল্যকালে প্রায় প্রতি ঈদে আমার পকেট থেকে টাকা হারাত। কারণ ঈদগাহ মাঠ থেকে স্থানীয় বাজার পর‌্যন্ত আমি সবার সঙ্গে মোলাকাত এবং খুনসুটিতে মেতে থাকতাম। বাসায় এসেই দেখতাম পকেটে টাকা নেই। প্রায় ঈদের দিন এমন হওয়ায়, একটা সময় অবশ্য মা সকালেই পকেট থেকে আমার টাকা নিজ হেফাজতে রাখতেন। বাসায় এসে পকেটের টাকা খুঁজতেই মা হাসাহাসি করত, পরে অবশ্য দিয়ে দিত।

বাল্যকালে একটা বিষয় নিয়ে আমার মন খারাপ থাকত, অনেক সময় ঈদের দিনও। কারণ আমি অষ্টম শ্রেণি অব্দি আটটা বিদ্যালয় পরিবর্তন করতে হয়েছে। বাবা সরকারি চাকরি করত, যেখানে ট্রান্সফার হতো, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। শিশুকালে গ্রামে কিছুদিন থাকলেও ওই সময় তিনটা বিদ্যালয় পরিবর্তন করা অলরেডি শেষ। বিদ্যালয়গুলোতে কিছুদিন অতিবাহিত করা মাত্রই আমার সঙ্গে অনেকের খুব বন্ধুত্ব হয়ে যেত। আমি স্কাউট, বিএনসিসি, আন্তঃবিদ্যালয় টুর্নামেন্ট এবং ডিবেটিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকতাম। এ কারণে সহপাঠী এবং শিক্ষকদের সঙ্গে দিন কয়েকের মধ্যেই সুসম্পর্ক তৈরি হতো। তখন মোবাইল ইন্টারনেটের যুগ না থাকায়, অধিকাংশকে পরবর্তী জীবনে আর খুঁজে পেতাম না। মনে পড়লেই ঈদের দিনও আমার কান্না আসত। অধিকাংশকে আর কখনো খুঁজে পাইনি, ও হারানো বন্ধু তোমরা শুনতে কি পাও, এ লেখা আমার।

কোন এক ঈদের আনন্দের মধ্যে আমার জীবনে বিষাদ নেমে আসে। আমি দিনাজপুরের হিলি বন্দরের পার্শ্ববর্তী নবাবগঞ্জের দাউদপুর ডিগ্রি কলেজে মাদকবিরোধী ক

নসার্ট করেছিলাম। কনসার্টে স্থান পাওয়া একটি লোকসংগীত আমার এখনো মনে পড়ে। গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। কর্মসূচি শেষ করে আমি ঢাকা হয়ে সিলেট গমন করি। সিলেট থেকে মাদক কারবারিরা আমাকে অপহরণ করে ভারতে নিয়ে যায়।

এবার রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সংগঠনের অগণিত নেতাকর্মী ও সমর্থক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। রমজানে মায়ের হাতের ইফতার তাদের ভাগ্যে জোটেনি। পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনেও মায়ের হাতে সেমাই, মিষ্টি, চটপটি, ফিরনি, ফালুদা থেকে তারা যেন বঞ্চিত না হয়। সবাই নির্বিঘ্নে নিজ গৃহে পরিবারের সঙ্গে যেন ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে- এ ব্যবস্থাটি করার জন্য বাংলাদেশ সরকার, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। ঈদের সময় ও পক্ষ-বিপক্ষ তকমা দিয়ে কারও ওপর যেন হামলা করা না হয়। মনে রাখতে হবে- জীবন রক্ষা করা সবার অগ্রাধিকার। তারপর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা সবার মৌলিক অধিকার। আমি আশাবাদী এই ঈদে মৌলিক অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হবে না। কারণ বাংলাদেশে ক্ষমতায় রয়েছেন একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী।

এবার ঈদেও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে আমার ঈদ উদযাপন করা হচ্ছে না। কারণ ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল এর আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকতে হবে। ঈদ ৩১শে মার্চ হলে, আমার ঈদ চেন্নাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে/সংলগ্ন স্থানে উদযাপন করতে হবে। আর যদি পহেলা এপ্রিল হয়, তবে আমার ঈদ-উল ফিতর শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে উদযাপন করতে হবে।

স্বাগতম হে ঈদুল ফিতর স্নিগ্ধতা সাগরের আকাশের বিশালতায়, যায় না মাপা কখনো উ তার মন, চাঁদ তারা আর সূর্যেও উপমা, তার তুলনা খুব কম, প্রকৃতির যত উদারতা রূপ লাবণ্য, দু চোখের মুগ্ধতা সব তারই জন্য, অনাদিকালের অপেক্ষায়, পৃথিবীর তাবৎ ধন রাশি আর হীরা জহরত, লুটাই তার পায়, কোন কিছুতেই পাইনা আমি তোমার কোন কুল, তবু যে হৃদয় তোমাতে ব্যাকুল, বিদায় হে মাহে রমজান, স্বাগতম হে ঈদুল ফিতর, তোমার লাগি অশ্রু সজল করে নিলাম বিদায়, একবার ধরা দাও না তুমি হে উ, বিদায় বাংলাদেশ, স্বাগতম লংকা।

আসুন এবার ঈদের আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিই। পোশাক-আশাকের এই সস্তার জমানায় কেউ যেন ঈদুল ফিতরের দিন পুরোনো জামা কাপড় পরতে না হয়। আসুন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিগণ দেরি না করে, এখনই পার্শ্ববর্তী ঘরবাড়ি, পাড়া ও মহল্লায় খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

লেখক: ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল

আবীর

×