
মিষ্টি আলু খেত পরিচর্যা করছেন কৃষক
পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ও স্বাদে ভরপুর কন্দাল জাতীয় লতানো উদ্ভিদের ফসল মিষ্টি আলু। সময়ের তালে বদলে যাচ্ছে এর উৎপাদন ও বাজারজাত। হালে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে; বিদেশে রপ্তানি। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষি, খাদ্য ও শস্যসমৃদ্ধ অঞ্চল শেরপুরের উৎপাদিত মিষ্টি আলু এবার রপ্তানি হচ্ছে জাপানে। জেলার চরাঞ্চলে চাষ হচ্ছে মিষ্টি আলুর। এতে লাভবান হচ্ছেন এলাকার আলুচাষিরা। আলু চাষে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ প্রশস্ত হওয়ায় আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের।
নদীবিধৌত শেরপুরের প্রায় ৫ উপজেলাতেই রয়েছে বিস্তৃত চরাঞ্চল। আর ওইসব চরাঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই স্থানভেদে কমবেশি চাষ হয়ে আসছে মিষ্টি আলুর। একসময় অভাবে আলুর চাহিদা থাকলেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর থেকে এ অঞ্চলে মিষ্টি আলুর চাহিদা ক্রমেই কমে আসছিল।
হতদরিদ্র ও ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক পরিবার ছাড়া মিষ্টি আলুর চাহিদা মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে নেই বললেই চলে। ফলে নিজেদের উৎপাদিত আলু বাইরেও খুব একটা বিক্রি করা যেত না। নিজেদের খাবার চাহিদা মিটিয়ে স্থানীয়ভাবেই বিক্রি করতে হতো স্বল্প দামে। মিষ্টি আলুর সেই দুর্দিনে এবার যোগ হয়েছে ভিন্ন মাত্রা। বদলে যাচ্ছে পরিবেশ।
কয়েক বছর যাবত জাপানি একটি কোম্পানির উৎসাহে শেরপুরের চরাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে মিষ্টি আলুর চাষ হচ্ছে। এজন্য সদর উপজেলার বলাইয়েরচর, চরমোচারিয়া ও কামারেরচরে মিষ্টি আলু চাষের জন্য ৪৩ কৃষকের সঙ্গে চুক্তি করে নারুতো জাপানি কোম্পানি লিমিটেড। তাদের চুক্তি মোতাবেক ৯০ একর জমিতে কোকোই-১৪ জাতের মিষ্টি আলু চাষ করেছেন স্থানীয় কৃষক।
আলু চাষের উপকরণ বীজ, সার, কীটনাশক সব বিনামূল্যে দিয়েছে ওই কোম্পানি। উৎপাদনের পর প্রকল্পের সব আলু তারা ন্যায্যমূল্যে কিনে নেবে। এ আলু প্রসেসিং করে চিপস, মিষ্টি রেডিফুড তৈরি হয়। এছাড়া এটি সেদ্ধ করে প্রসেসিং ফুড হিসেবে জাপানে বিক্রি হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ২০৫ হেক্টর জমিতে মিষ্টি আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চাষ হয়েছে ২১২ হেক্টর জমিতে। জাপানে রপ্তানির কথা শুনে এবং লাভজনক ফসল হওয়ায় আলু চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। মিষ্টি আলু ভীষণ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ একটি লতানো উদ্ভিদ। এতে প্রচুর বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি৬ ও ফাইবার রয়েছে। হাত-পায়ের আঙুল ফোলা কমানো, প্রসবের সমস্যা দূর করতে এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য এর পাতা ও মূল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কৃষিবিদরা জানান, অতিরিক্ত ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না এ আলু। গড় তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এ আলুর জন্য কার্যকরী। ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটি মিষ্টি আলু চাষের উপযোগী। তাই সবজির পাশাপাশি মিষ্টি আলু চাষে জোর দিলে কৃষি অর্থনীতিতে নবদিগন্তের সূচনা হবে বলে মনে করছেন কৃষিবিদরা।
সরেজমিনে গেলে কথা হয় নারুতো জাপানি কোম্পানি লিমিটেডের ফিল্ড অফিসার মো. জাকারিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, তাদের কোকোই জাতের আলু ভীষণ সুস্বাদু। কোম্পানিটি কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি আলু কিনে নিয়ে সেদ্ধ আলু, চিপস, মিষ্টি এসব তৈরি করে বিক্রি করবে। পাশাপাশি জাপানেও পাঠাবে আলু। ওই সময় কথা হয় সদর উপজেলার বলাইয়েরচর ইউনিয়নের জঙ্গলদি নয়াপাড়া গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলমের সঙ্গে।
তিনি জানান, কোম্পানি তাদের সার, বীজ, কীটনাশক সবকিছু দিয়েছে। এক বিঘা জমিতে ৭০ থেকে ৮০ মণ আলু সাধারণত ফলন হয়। তাদের সম্ভাব্য খরচ ১০-১৫ হাজার টাকা। মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহে আলু সংগ্রহ করবেন তারা। উৎপাদিত আলু ৬৫০ টাকা মণ দরে কিনে নেবে। বিঘাপ্রতি আলুর বিক্রি মূল্য হবে ৪৫ হাজার টাকার মতো। এতে তাদের ৪০-৪৫ হাজার টাকা লাভ থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
কৃষক রফিক মিয়া বলেন, তিনি গতবার এক একর জমিতে মিষ্টি আলুর চাষ করেছিলেন। ৫৮০ টাকা মণ দরে আলু বিক্রি করে খরচ বাদ দিয়ে ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। এবার দাম বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা মণ করায় বাড়তি লাভের আশা করছেন তিনি। একই কথা জানান কৃষক মো. মাসুদ মিয়াসহ বেশ কয়েকজন। এদিকে এই আলু চাষে কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয় নারী-পুরুষদেরও। আলু তোলার মৌসুমে দিন হাজিরায় কাজ করে বাড়তি আয় করছেন তারা।
এ ব্যাপারে শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন জানান, মিষ্টি আলু একটি কন্দাল জাতীয় ফসল। শেরপুরের চরাঞ্চলের মাটি মিষ্টি আলু চাষের জন্য খুবই উপযোগী। উৎপাদিত আলু ভীষণ স্বাদের। এ আলু প্রক্রিয়াজাত করে অনেক খাদ্যপণ্য তৈরি করে জাপানে রপ্তানির পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সুপারশপে বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, অন্যান্য মিষ্টি আলুর উপরের অংশ (ছাল) সাধারণত ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু এ জাতের মিষ্টি আলু চামড়াসহ খাওয়া যাবে। জাপানিরা এ আলু সেদ্ধ করে কেকের মতো প্যাকেট করে বিক্রি করেন। তার মতে, জাপানের একটি কোম্পানি মিষ্টি আলুর উদ্যোক্তা হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ প্রশস্ত হচ্ছে।