ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১

​​​​​​​আজ চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী

আধুনিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

​​​​​​​বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ২১ মার্চ ২০২৫

আধুনিক সাংবাদিকতার  পথিকৃৎ আতিকউল্লাহ  খান মাসুদ

মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

নীতির প্রশ্নে আপোসহীন এবং ন্যায়ের প্রশ্নে অবিচল ছিলেন আধুনিক সাংবাদিকতার পথ প্রদর্শক বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। বিশিষ্ট এই শিল্পপতির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ ২২ মার্চ। ২০২১ সালের এই দিনে ৭১ বছর বয়সে ঢাকায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ক্ষণজন্মা এই সাংবাদিক।

বাংলাদেশের আধুনিক সাংবাদিকতার জগতে মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ একজন প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবসময় নিজেকে এবং সাংবাদিকতাকে নিয়োজিত করে গেছেন। নির্ভীক সাংবাদিকতার এক পথিকৃৎ তিনি। তার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক জনকণ্ঠ সব সময় জনমানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে জনগণের কথা বলে যাচ্ছে। 

দৈনিক জনকণ্ঠ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে জীবনব্যাপী তিনি এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এদেশের সাংবাদিকতায় এনে দিয়েছেন নতুন মোড়। 

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ এদেশের তৃণমূলের মানুষের কাছে স্বল্প সময়ে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার দুঃসাহস করেন। লক্ষ্যে সংবাদপত্র শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগেও তিনি সফল হন। দেশের পাঁচ বিভাগীয় শহর থেকে দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশ করে দেশের সংবাদপত্র শিল্পে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন।

শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে তার প্রকাশিত পত্রিকায় গণমানুষের কথা তুলে আনেন অত্যন্ত সাহসীকতার সঙ্গে। জন্য বার বার আঘাত এসেছে নানা পক্ষের কাছ থেকে। তাতে তিনি ভীত হননি। বরং সাহসের সঙ্গেই তিনি  দেশের মানুষের জন্য আমৃত্যু নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। সেজন্য তিনি এদেশের মানুষের কাছেনির্ভীক সাংবাদিকহিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।

আতিকউল্লাহ খান মাসুদ সব সময় মনে করতেন, সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষের কথা বলা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা, মানুষের সমস্যা, সমাজের অসঙ্গতি অন্যায় অবিচার তুলে ধরা। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আজও দৈনিক জনকণ্ঠ আতিকউল্লাহ খান মাসুদের সেই নীতি অবলম্বন করেই প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে জনকণ্ঠ অনলাইন এবং জনকণ্ঠ ডিজিটাল। 

১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি স্বল্প প্রযুক্তির যুগেও ডিজিটাল ব্যবস্থায় দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশ করে দেশের গণমাধ্যম জগতে পুরনো গতানুগতিক ধাঁচ উপড়ে দিয়েছিলেন। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশের পাঁচটি বৃহত্তর বিভাগীয় শহর থেকে একসঙ্গে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে দেশের সংবাদ শিল্পে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেছিল দৈনিক জনকণ্ঠ। দেশের তৃণমূল মানুষের কাছে দিনের পত্রিকা দিনেই পৌঁছে দেওয়ার ব্রত নিয়ে তিনি প্রকাশ করেন দৈনিক জনকণ্ঠ।

আজকের দিনে নতুন পত্রিকা, অনলাইন বা টেলিভিশন চ্যানেলের আত্মপ্রকাশ নিত্য ঘটনা। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এটা ছিল বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ জয় করেই তিনি পাঠকের হাতে তুলে দেন নতুন ধারার এক পত্রিকা দৈনিক জনকণ্ঠ। যা সংবাদপত্র শিল্পে ওই সময়ের বিনিয়োগেও নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করে।

শত বাধা কিংবা কোনো রক্তচক্ষু বা অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করেননি আতিকউল্লাহ খান মাসুদ।  কান্ডারির মতো কলমের মাধ্যমে তা রুখে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ছিলেন উদার মানসিকতার ধারক। একজন মালিক সম্পাদক হয়েও তার কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না, ছিল না ব্যক্তিগত কোনো লোভ। কারণেই সৎ নির্মোহ অবস্থান থেকে সত্য কথা বলার সাহস দেখাতে  পেরেছেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং সরকারের অসহযোগিতাকে মোকাবিলা করে, নীতির প্রশ্নে অবিচল থেকে তিনি মানুষের কথা বলে গেছেন তার সংবাদপত্রে।

আজকের সাংবাদিকতায় বাণিজ্য মুনাফা প্রধান লক্ষ্য, কিন্তু সে মোহ তাকে কখনো আকর্ষণ করেনি। বরং সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনমানুষের জন্য লড়াই ছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য। তিনি শুধু একজন সংবাদপত্রের মালিকই ছিলেন না, ছিলেন জনজীবনভিত্তিক সাংবাদিকতারও পথিকৃত।

মানুষের প্রত্যাশা, বেদনাকে জোরালোভাবে তুলে ধরার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। শুধু সাংবাদিকতার প্রথপ্রদর্শক হিসাবেই নন, মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার সংস্পর্শে যিনি একবার এসেছেন, তিনি তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তেমনি তার সহানুভূতিশীল হৃদয় মানুষের প্রতি মমতাবোধ আজও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়।

তাই তো কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান...’ কবিগুরুর কবিতার এই পঙ্ক্তিমালা শতভাগ সত্য বলেই প্রমাণ করে গেছেন আধুনিক সংবাদপত্রের জনক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ।

আতিকউল্লাহ খান মাসুদের সংক্ষিপ্ত জীবনী মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ১৯৫১ সালের ২৯ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার মেদিনীমন্ড গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত সাহসী জনাব মাসুদ যুবক বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে নং সেক্টরের অধীনস্থ মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানা কমান্ডার হিসাবে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেন এবং অনেক বড় বড় অপারেশনে অংশ নেন।

বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে ১৯৭২ সালে সফলভাবে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে কর্মজীবন শুরু করেন। তৎকালীন সফল তরুণ শিল্পপতিদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তিনি বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন।

১৯৭৮ সালে তিনি সাফল্যের সঙ্গে জাপানের কারিগরি সহযোগিতায় গ্লোব ইনসেক্টিসাইডস লিঃ নামে দেশের প্রথম মশার কয়েল প্রস্তুতকারী শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ধোঁয়াবিহীন মশা নিবারক গ্লোব ম্যাট তেলাপোকা ধ্বংসকারক গ্লোব অ্যারোসল এই দুটি পণ্য উক্ত কারখানায় উৎপাদন শুরু করা হয়। ১৯৯০ সালে গণচীনের কারিগরি সহযোগিতায় গ্লোব মেটাল কমপ্লেক্স লিমিটেড নামে আরও একটি ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন।

 ১৯৯৩ সালে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সফল শিল্পপতি হিসাবে তার জীবনের সবচেয়ে সফল সংযোজন দেশের অন্যতম এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকাদৈনিক জনকণ্ঠপ্রকাশ করেন। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পাদক, মুদ্রাকর প্রকাশক হিসাবে তিনি এই জাতীয় দৈনিকটি সর্বপ্রথম অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সমন্বয়ে দেশের ৫টি স্থান থেকে একই সঙ্গে প্রকাশ করে দেশের সংবাদপত্র শিল্পে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন।

জনাব মাসুদ ১৯৯৭ সালে ডেইরি কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য গ্লোব খামার প্রকল্প নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৯৯৮ সালে দেশের গৃহায়ন সমস্যা বিশেষ করে মধ্যবিত্ত উচ্চ মধ্যবিত্ত নাগরিকদের জন্য গৃহায়ন সমস্যা সমাধানকল্পে  গ্লোব কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামে আরও একটি গৃহনির্মাণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০০ সালে তার উপরোক্ত সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সমন্বয়কারী হিসাবে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

জনাব মাসুদ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন। ১৯৮৪-৮৬ তিনি সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সহ-সভাপতি ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮৫-৮৬ সালে গরিব অনাথ শিশুদের বিনা খরচে চিকিৎসা ওষুধ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি বিক্রমপুরের লৌহজং মহাবিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন।

×