
আতিকউল্লাহ খান মাসুদ
তাঁর চরিত্রে ঝাঁজ ছিল, তেজ ছিল, জমিদার বংশের মানুষ, তাই চরিত্রে তো একটু ঝাঁজ থাকবেই! আর এই ঝাঁজ এবং তেজই তাঁকে কারও কাছে মাথা নত করতে দেয়নি। আমার মনে হয় প্রতিটি মানুষের মাঝেই এই তেজ এবং ঝাঁজের সদগুণ থাকা চাই। আর ঝাঁজ এবং তেজের সদগুণই হলো চরিত্রের দৃঢ়তা-
লন্ডন থেকে সরাসরি ঢাকায় আসতে ডিউটি-টাইম বেশি হয়ে যায় বলে দুই সেট ককপিট ক্রুর ব্যবস্থা করা হতো। এক সেট ক্রু অর্ধেক পথ ফ্লাইং করত এবং অন্য সেট বিশ্রামরত থাকত। সবচেয়ে সিনিয়র পাইলট হতো ক্যাপ্টেন। ওই দিন আমি ছিলাম ওই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন। আমি প্রথমে বিশ্রামে ছিলাম। তখন আলাপ হয় আতিকউল্লাহ খান মাসুদের সঙ্গে। তিনি লন্ডন থেকে ঢাকা আসছিলেন। আমার বন্ধু হামিদুল্লাহ খানের ভাই বলে তাঁর সঙ্গে আগ্রহ নিয়েই আলাপ করছিলাম। তাঁর চেহারায় আভিজাত্য ছিল। অনেক বিষয়েই তাঁর জ্ঞানের ব্যাপ্তি ছিল যথেষ্ট। তিনি কথা প্রসঙ্গে বললেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর ব্যক্তিগত নোট বইয়ে লিখে রেখে গেছেন, পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চল পঁচিশ বছরের বেশি স্থায়ী হবে না। Mountbatten And The Partion Of India বইয়ে এ তথ্য উল্লেখ করা আছে। ঢাকার ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ১৯৮২ সালে বইখানা প্রকাশ করে। বুঝতে পারলাম বইখানা তিনি পড়েছেন। আমিও পড়েছি। একথাও বুঝতে পারলাম, মাসুদ ভাই অফিসে বসে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের কথাই চিন্তা করেন না, পড়াশোনাও করেন।
আতিকউল্লাহ খান মাসুদের চেয়ে তাঁর বড় ভাই উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খানের সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল বেশি। হামিদুল্লাহ খান যখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রোভোস্ট মার্শাল ছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হতো। তুলনামূলকভাবে আতিকউল্লাহ খান মাসুদের সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছে কম। ১৯৮৫ বা ১৯৮৬ সালে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল এবং আমরা দীর্ঘ সময় নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেছিলাম।
তাঁর সততা, সাংবাদিকদের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। জনকণ্ঠ পত্রিকা শুরু করার পর ওই পত্রিকাকে বাংলাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পত্রিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিনিয়োগ করেছিলেন। ওই সময় জনকণ্ঠ পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ছিল অন্যান্য পত্রিকার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেও পত্রিকাটি বেশ লাভজনক অবস্থানে। তখন আমরা যারা ওই পত্রিকায় লেখালেখি করতাম, তাঁদেরকে প্রতিটি লেখার জন্য সম্মানী ভাতা চেকের মাধ্যমে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হতো। যে পরিমাণ সম্মানী ভাতা দেওয়া হতো, তা তখনকার মুদ্রামানে উপেক্ষা করার মতো ছিল না।
আতিকউল্লাহ খান মাসুদ শত শত কোটি টাকার ক্ষতি মেনে নিয়েও আপোসকামী হননি। আপোসকামী হলে হয়ত শত শত কোটি টাকার ক্ষতির পরিবর্তে হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পারতেন।
আত্মমর্যাদা এবং ত্যাগের মহিমার কারণে আতিকউল্লাহ খান মাসুদ আমাদের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। আর যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে জনকণ্ঠ পত্রিকার মান আজও ধরে রেখেছেন তাঁদেরকে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই।
আতিকউল্লাহ খান মাসুদের শুধু গুণকীর্তন করব তা তো হয় না। একথা বলতেই হবে, তাঁর চরিত্রে ঝাঁজ ছিল, তেজ ছিল, জমিদার বংশের মানুষ, তাই চরিত্রে তো একটু ঝাঁজ থাকবেই! আর এই ঝাঁজ এবং তেজই তাঁকে কারও কাছে মাথা নত করতে দেয়নি। আমার মনে হয় প্রতিটি মানুষের মাঝেই এই তেজ এবং ঝাঁজের সদগুণ থাকা চাই। আর ঝাঁজ এবং তেজের সদগুণই হলো চরিত্রের দৃঢ়তা।
আমার মনে পড়ে একদিন জনকণ্ঠ অফিসে গেলাম। দেখলাম, মাসুদ ভাই লিফটে চড়তে যাচ্ছেন। আমাকে বললেন, আসুন আমার কক্ষে। গেলাম তাঁর সঙ্গে। এক কাপ চা পান করলাম। তেমন কোনো বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। তিনি শুধু বললেন, জানেনই তো কত ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বললাম, কিছু কিছু জানি, সব না। এরপর চলে এলাম। এমনও দিন গেছে, জনকণ্ঠ পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিকদের মাসের পর মাস মাইনে দিতে পারেননি। যারা খুব আর্থিক চাপের মধ্যে ছিলেন, তাঁদের অনেককে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য পত্রিকায় গিয়ে যোগ দিতে হয়েছে। আর অনেকেই অন্য পত্রিকায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েও আতিকউল্লাহ খান মাসুদের প্রতি আনুগত্যের কারণে জনকণ্ঠেই রয়ে গেছেন।
ফ্লাইটের অর্ধেক পথ অতিক্রম করে এসেছি। যাত্রীরা এবং আমি রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছি। আমি তখন ককপিটে গিয়ে বসব। তাই বললাম, মাসুদ ভাই এই প্রথম শ্রেণির পেছনের দিকে কয়েকটি আসন ককপিট ক্রুদের জন্য নির্দিষ্ট করা থাকে। কেবিন ক্রুরা আসনের হাতল তুলে নিয়ে কম্বল বিছিয়ে আপনার শোওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
হায়! মাসুদ ভাই আজ চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কোনো ডাকেই আর সাড়া দেবেন না তিনি।
লেখক: বৈমানিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক