
.
‘যারে উড়ে যারে পাখি/ ফুরালো প্রাণের মেলা/ শেষ হয়ে এলো বেলা/ আর কেন মিছে তোরে বেঁধে রাখি। আকাশে আকাশে ফিরে/ যা ফিরে আপন নীড়ে/ শ্যামল মাটির বনছায়...’
এই উপমহাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী প্রয়াত লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া গানটির কথাগুলোর মতো করেই ওরা নিজ গন্তব্যে পাখা মেলেছে।
পরিযায়ী পাখি। শীতের শুরুতে দেশের উত্তরাঞ্চলে এদের আগমন ঘটেছিল। শীত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। যেন গরম পড়তেই এবার ঘরে ফেরার পালা। শহর ও শহর সংলগ্ন বড় বড় দীঘি, নদীর চর, খাল বিল জলাশয় ছেড়ে বাড়ির পথ ধরছে পরিযায়ী পাখিরা। পরিযায়ী পাখি বলতে বোঝায়, যারা পরিভ্রমণ করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, আবার পূর্বের স্থানে ফিরে আসে। প্রতিবছর শীতকালে হিমালয় পর্বতমালার আশপাশের অঞ্চল, উত্তর মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, চীনের কিছু অঞ্চল, রাশিয়া ও সাইবেরিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অনেক প্রজাতির পরিযায়ী পাখি উত্তরাঞ্চলসহ আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এসে শীত কাটিয়ে ফিরে চলে যায়। বর্ষার শেষে এবং শীতের শুরুতে এসব পাখি আসতে শুরু করে। আবার মার্চের শেষ দিকে বা বসন্ত কালে যখন এই অঞ্চলের দিকে গরম পড়তে শুরু করে এবং শীতপ্রধান এলাকায় বরফ গলাও শুরু হয়, তখন পাখিগুলো নিজ এলাকায় ফেরত চলে যায়। পাখিগুলো যেসব দেশ থেকে আসে, সেখানে প্রচ- শীত থাকে। শীতে তুষারপাতের কারণে পাখিদের বিচরণক্ষেত্র ঢেকে যায় বলে নতুন গাছপালা জন্মাতে পারে না, খাদ্যের সংকট তৈরি হয়। মূলত খাবারের সন্ধানে, প্রজনন ও ছানাদের লালন-পালনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের খোঁজে পাখিরা পরিযায়ী হয় আমাদের দেশে।
শুক্রবার কথা হলো তিস্তাপাড়ের ডালিয়া এলাকার বাসিন্দা শৌখিন ফটোগ্রাফার রাসেল কাজী জানান, গরম পড়েছে পাখিগুলো ফিরে যাচ্ছে তাদের আপন ঠিকানায়। তবে নদীর পরিবেশ-প্রকৃতি পাখিদের অনুকূলে থাকায় তিস্তাকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করছে এ পাখিগুলো। তিনি জানান, অসচেতনতার অভাবে সামান্য স্বার্থের কারণে বা শখের কারণে অনেকেই শীতের এ মৌসুমে পরিযায়ী পাখিদের শিকার করে থাকেন। এতে করে আমরাই আমাদের এই সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করছি। নদী ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য পাখির বিচরণক্ষেত্র রক্ষা করতে হবে। আমাদের দেশ ক্রমেই অতিথি পাখির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। শুধু আইন দিয়েই পাখি শিকার বন্ধ করা যাবে না। সর্বস্তরের মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
এদিকে নীলফামারী শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার অদূরে বিন্যাবতী দীঘিতে পরিযায়ী পাখিদের শেষ দলও উড়ে গেছে। কয়েক দিন ধরে তিস্তা নদী থেকেও ওদের যাওয়ার পালা শুরু হয়েছে। প্রতিবছরেই
পাখিপ্রেমী ও পরিবেশপ্রেমীরা লাগাতার ওদের গতিবিধির ওপরে নজর রাখেন। এ বারে শহরের জলাশয়গুলোতে পরিযায়ী পাখি তুলনামূলক ভাবে কম এসেছে বলে দাবি পরিবেশকর্মী পাখিপ্রেমিক আলমগীর জানায়। তিনি বলেন, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, গাছ কাটা, নদী ও জলাশয়ে দূষণ ও দখলই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করেন তিনি।
এবার উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, ব্রক্ষ্মপুত্র নদনদীসহ বিভিন্ন দীঘি, বড় বড় জলশায়,খালবিলে প্রচুর পরিযায়ী পাখির দেখা মিলেছিল। সরালি হাঁস, ব্রাহ্মণী হাঁস, কাপাসি ঈগল, উতরেপিনটেলসহ অন্য পাখিদের কলকাকলিতে এতদিন ভরে ছিল। গরম পড়তে শুরু হতেই ছানাপোনাদের নিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে সকলে। দল বেঁধে ফিরছে পুরানো চেনা পথে।
চলতি শীতে নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্ট থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত প্রায় ৬৫ কিলোমিটার তিস্তা নদী এবং নদীর চরে এখন বিচরণ করেছিল অগণিত পরিযায়ী পাখি। এর কোনোটা হাজার মাইল দূর থেকে এসে মোহনীয় করে তুলে প্রকৃতি ও পরিবেশ। বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ হাঁস, ছোট কান প্যাঁচা, লম্বা পা তিসাবাজ, জিরিয়া, টিটি, মনকান্ড, চখাচখিসহ ৫০ থেকে ৫৫ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে তিস্তায়।
এবার শীতে তিস্তা নদীর পাড়ে পাখির ছবি তুলেছিলেন নদী গবেষক ও শৌখিন আলোকচিত্রী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ। তিনি বলেন, প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিস্তায় কমবেশি পরিযায়ী পাখি আসে। প্রতিবছরের মতো এবারও আসে। তবে এবার অনেক নতুন পরিযায়ী পাখির দেখা পাওয়া যায় তিস্তায়। এবারের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, সারাবিশ্বে মহাবিপন্ন পাখি বলে চিহ্নিত হলদেবুক-চটক পাখির একটি ঝাঁক পুরো শীতকাল উত্তরাঞ্চলের তিস্তা নদীতে অবস্থান করেছিল।
এছাড়া তিস্তায় দেখা যায় সাইবেরিয়া বা রাশিয়া থেকে আসা ওয়েডার্স ও ডাক। ইউরোপ থেকে আসে ইউরোপিয়ান ফ্লাইক্যাচার, ব্রাউন-ব্রেস্টেড ফ্লাইক্যাচার, বার্ন সোয়ালের মতো আরও কত সব পাখি! খাবারের অভাব কিংবা প্রজননের সমস্যার মতো নানা কারণেই তাদের এই অনন্ত সফর। তবে আসল কারণ হয়তো উষ্ণতা। এই সময়ে আসা। আর মার্চ-এপ্রিলের দিকে ফিরে যাওয়া। এটাই তাদের সারাবছরের রুটিন। বলতে গেলে প্রতিবছর শীতকালে নানা ধরনের পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশে আসছে। তিনি বলেন এই পরিযায়ী পাখিগুলো হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে, বিপুল দূরত্ব অতিক্রম করে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। শীতের আগমন শীতপ্রধান অঞ্চলের পাখিদের জন্য এক প্রাকৃতিক অবস্থা, যা তাদের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জানা গেছে পরিযায়ী পাখিরা শুধু দীর্ঘ পথ পারি দেয় না, তারা বিভিন্ন কৌশলও ব্যবহার করে যাত্রার সঠিকতা নিশ্চিত করতে। একে বলা হয় ফ্লক ফ্লাইং বা ঝাঁকভাবে উড়ান। পাখিরা একত্রে দলবদ্ধ হয়ে উড়ে, যার ফলে তাদের পথ অনুসরণ করা সহজ হয় এবং তারা একে অপরের কাছ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা পায়।
একই সঙ্গে তাদের গতি নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হয় এবং ক্লান্তি কম হয়। এতে করে পাখিরা আরও দ্রুত এবং সঠিকভাবে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাখির অভিবাসন নিয়ে গবেষণা করেছেন। স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং এবং রেডিও ট্রান্সমিটার পাখির দেহে স্থাপন করে, তাদের চলাচল ও অভিবাসন পথ অনুসরণ করা হয়। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন, পাখিরা কখন এবং কোথায় বিশ্রাম নেয় এবং কীভাবে তারা বিপুল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। এসব তথ্য পাখির অভিবাসনকে আরও ভালোভাবে বোঝার পথ খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশে সাত শতাধিক প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পরিযায়ী। এদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ও বনায়ন সৃষ্টিতে পরিযায়ী পাখির ভূমিকা অনস্বীকার্য। এদের মল ত্যাগের ফলে এবং ঠোঁটে বীজ বহন করে চারা উৎপাদনের মাধ্যমে বনায়নের সম্ভব হয়। এরা ফুল-শস্যের পরাগায়ন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, জমির ফসলকে কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা করে কৃষকের উপকার করে কৃষি অর্থনীতিতেও অবদান রাখে। এরা পানিতে সাঁতরানোর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে। এদের বিষ্ঠা জমির উর্বরাশক্তি বাড়ায়, আবার এই বিষ্ঠা পানিতে মাছের খাবার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।