
ব্যারিস্টার রওশন আলী স্মরণে নির্মাণ করা উল্লাপাড়া উপজেলার প্রত্যান্ত অঞ্চল চলনবিলে ঈদগাহ মাঠ
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিলের নাম চলনবিল। পাবনা, নাটোর এবং সিরাজগঞ্জ এ তিন জেলাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট অনেক বিলের সমষ্টি এই চলনবিল। বর্ষায় দ্বীপের মতো ভাসমান সবুজ গ্রাম, শীতে অতিথি পাখির কলরব, সুনীল আকাশ, গ্রীষ্মে যতদূর চোখ যায় সবুজ ফসল, বিলের কোথাও কোথাও ছোট ছোট ডোবায় জেলেদের মাছ ধরার নৌকাগুলো আধাডুবু দেখা যায়। চলনবিলের সৌন্দর্যে যেন নয়ন জুড়িয়ে যায়। এই চলনবিলের বড় একটি অংশ রয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায়। এ উপজেলার উধুনিয়া, বড়পাঙ্গাসী ও মোহনপুর এই তিন ইউনিয়নকে মূল চলনবিল বলা যায়। বিল অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা শহরের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন। শহরের মানুষ শখের বশে বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে যায় আর বিলে বসবাসরত মানুষ আজন্ম নানান সমস্যায় বিলের মধ্যে জীবন কাটিয়ে দেয়। দর্শনার্থীদের চোখে বিলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ফুটে না উঠলেও এখানে বসবাসরত মানুষ প্রতিনিয়তই অনুভব করে নানান দুঃখ বেদনা। বিলের মানুষের যাতায়াত সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও কিছু কিছু সমস্যা অবলোকন করা যায়। এরমধ্যে বর্ষাকালে লাশ দাফন ও জানাজা নামাজ ও পবিত্র ঈদের নামাজ আদায়ে প্রত্যন্ত বিল অঞ্চলের মানুষের অনেকটাই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কখনো নৌকা কখনো মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেন প্রত্যন্ত বিলের মানুষ। শুষ্ক মৌসুমে অসমতল ভূমিতেও নামাজ আদায় কষ্ট ভোগ করতে হয় মানুষের। বিলের অবহেলিত অঞ্চলের মানুষগুলো প্রতিবছর পবিত্র ঈদের নামাজ শেষে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, কবে তাদের এই দুঃখ-দুর্দশা শেষ হবে। তারা আফসোস করেন এই অবস্থার কোনদিনও অবসান হবে না হয়তো। চলনবিল অধ্যুষিত অধিকাংশ গ্রামেই বর্ষাকালে মসজিদে এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি নেমে যাওয়া এবরো-থেবরো জমিতে নামাজ আদায় করতে হয়। এসব অঞ্চলের মানুষগুলো রাজনৈতিক নেতা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বারদের কাছে বন্যাসহায়ক ঈদগাহ নির্মাণের দাবি জানিয়ে এলেও তাদের দাবি কেউ কখনো কর্ণপাত করেনি।
চলনবিল অধ্যুষিত উল্লাপাড়া উপজেলার বড়পাঙ্গাসী ইউনিয়নের নরসিংহপাড়া শুকলাই ও শুকলাইহাট। এ তিনটি গ্রাম চলনবিলের পাদদেশে অবস্থিত। বর্ষায় অথৈ পানি আর শুষ্ক মৌসুমে সবুজ ফসলের মাঠ। তিন গ্রামে বসবাসকারীর সংখ্যা কয়েক হাজার। এখানকার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি, এছাড়াও বর্ষায় তারা মাছ ধরেও জীবিকা নির্বাহ করে। অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রার মান মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত। একসময় যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই করুণ থাকলেও বর্তমানে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বছরের চারমাস এ অঞ্চলগুলো পানিতে নিমজ্জিত থাকে। বাকি সময় আধাপানি অর্থাৎ কোথাও পানি কোথাও শুকনা। এ সময় বিলে নানান রকম ফসল চাষ হয়ে থাকে। বর্ষাকালে এখানকার মানুষের যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌকা আর অন্যান্য সময় হেঁটে চলতে হয় এখানকার মানুষের। এ গ্রামগুলোর মানুষের নানান সমস্যার মধ্যে প্রধান সমস্যা ছিল পবিত্র ঈদের নামাজ আদায় এবং মৃত ব্যক্তির জানাজা নামাজে। অবহেলিত তিনটি গ্রাম বর্ষায় কানায় কানায় পানিতে ভর্তি হয়ে থাকতো ফলে তিন গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানের ঈদগায়ে ঈদের নামাজ পড়া সম্ভব হতো না। প্রতিবছর ঈদে নরসিংহপাড়া শুকলাই ও শুকলাইহাট গ্রামের মানুষের মনে আনন্দের চেয়ে বেদনাই বেশি থাকত। এই গ্রামগুলোর যেসব মানুষ শহরে বসবাস করে তাদেরও ঈদে গ্রামে আসার আগ্রহ থাকত না। এমনকি এ গ্রামের জামাইরাও ঈদে শ্বশুরবাড়িতে আসতে দ্বিধা করতেন। তারা বলতেন যেখানে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়া যায় না সেখানে গিয়ে কি হবে। গ্রামের লোকজন ঈদের দিন সকালে নতুন জামা কাপড় পরে তিন গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানের ঈদগাহে নৌকা কেউ কলার ভেলা কেউ বা জামা কাপড় হাতে নিয়ে গামছা পরে পানিতে সাঁতরে এসে ঈদগাহে উপস্থিত হতেন। সেখানেই নৌকায় সারিবদ্ধভাবে ঈদের নামাজ আদায় করতেন যুগের পর যুগ। নামাজ শেষে মোনাজাতে তারা আল্লাহর কাছে এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চাইতেন। এমনকি এ গ্রামের মানুষ স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বারদের কাছেও আকুতি জানিয়েছেন একটি বন্যাসহায়ক ঈদগাহ নির্মাণের জন্য। সকলেই এটি অসাধ্য কাজ বলে গুরুত্ব দেয়নি।
যেভাবে নির্মাণ হলো একমাত্র বন্যাসহায়ক ঈদগাহ
২০১২ সালে নরসিংহপাড়ার ব্যারিস্টার রওশনের পুত্র কবি, সাহিত্যিক, প্রকাশক সাংবাদিক মোস্তফা জাহাঙ্গীর ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে ঈদ উদযাপনে আসেন। গ্রামে গিয়ে তিনি তিন গ্রামের মানুষের সঙ্গে নৌকায় দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় ঈদগাহে পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করেন। তখনই তার মনে গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের এই কষ্ট অনুভূত হয়। এরপর তিনি পরিকল্পনা করেন একটি বন্যাসহায়ক দ্বিতল ঈদগাহ নির্মাণ করার। তার এ পরিকল্পনা গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে জানালে গ্রামবাসী তার এ পরিকল্পনা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে অনেকেই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। গ্রামের মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা আর সাহস পেয়ে মোস্তফা জাহাঙ্গীর ঈদগাহ নির্মাণের চূড়ান্ত সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি তার পরিচিত বন্ধুদের দিয়ে বন্যাসহায়ক দ্বিতল ঈদগাহ এর একটি নকশা তৈরি করেন। ১০০ ফুট বাই ১০০ ফুট বর্গাকারে একটি ডিজাইন করেন যেখানে দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ একত্রে নামাজ আদায় করতে পারবেন। এরপর তিনগ্রামের মানুষের সঙ্গে বৈঠক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে সময় গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে কিছু অনুরোধ জানানো হয়। তাহলো- ঈদগাহটি তিন গ্রামের মানুষের, তাই সবার আন্তরিকতার সহিত একাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। নির্মাণ সামগ্রী দিন রাত সবসময় মাঠে পড়ে থাকলেও কেউ যেন এগুলো চুরি করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং যখন যেমন লোকবলের প্রয়োজন হবে সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।
কয়েকটি মিটিং করার পর নির্মাণ কাজের জন্য মাটি কাটার উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে অতিথি না করে সকলের সিদ্ধান্তে তিন গ্রামের ছয়জন প্রবীণ মুরব্বিকে অতিথি করা হয়। তারা যদি হেঁটে আসতে পারে প্রয়োজনে তাদের ভ্যানে করে এনে উদ্বোধন করার সিদ্ধান্ত নেন কমিটি। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর দ্বিতল ঈদগাহ মাঠের মাটি কাটার উদ্বোধনের দিন ধার্য করা হয়। তিন গ্রামের মানুষের মধ্যে সেদিন যেন ঈদের আমেজ সৃষ্টি হয়েছিল। সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক-পরিচ্ছদ পরে দল বেঁধে মিলাদ মাহফিল ও দোয়ায় অংশ নেন। এ তিন গ্রাম ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের জনসাধারণ ও বিশেষ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গও অংশ নেন কেন্দ্রীয় ঈদগাহে। বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীদের উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্য করার মতো। মাটি কাটা কাজের উদ্বোধন করেন নরসিংহপাড়ার আলহাজ আহসান আলী আখন্দ, আলহাজ জহের আলী আখন্দ, শুকলাই গ্রামের আলহাজ বেলায়েত ফকির, সোরমান প্রামাণিক, শুকলাইহাট গ্রামের ইউনূস আলী প্রামাণিক ও খোরশেদ প্রামাণিক তিন গ্রামের এই ছয় প্রবীণ ব্যক্তি কোদাল হাতে নিয়ে বন্যাসহায়ক দ্বিতল ঈদগাহ মাঠের মাটি কাটা কাজের উদ্বোধন করেন। ঈদগাহ মাঠটি চলনবিলের পাদদেশে হওয়ায় সেখানে নির্মাণ কাজেও অনেক বিপত্তি দেখা দেয়। কারণ বছরের কয়েকমাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে এই অঞ্চল। তাই নির্মাণ কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নির্মাণে ব্যবহৃত সামগ্রী পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে আর আশপাশের বাড়িতে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। এরপর শুরু হয় নির্মাণকাজ। ৪০টি পিলারের ওপর নির্মিত হয় দ্বিতল ঈদগাহ মাঠটি। এছাড়া গেট ও মেহরাবের জন্য আরও চারটি পিলার তোলা হয়। ঈদগাহের সামনে আধুনিক ডিজাইনের একটি মেহরাব তৈরি করা হয় যা অনেক দূর থেকে চোখে পড়ে। এই মেহরাবটি ঈদগাহটির সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করেছে। ঈদগাহ মাঠের পূর্ব দিকে মূল গেটের দুইপাশে দুটি সিঁড়ি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। মূল গেটটি ৩০ ফুট উঁচু এবং পাশে ২০ ফুট বিশিষ্ট মূল গেটটির উপরে পিলারের ওপর বড় আকারে চাঁদ, তারা দুইপাশে ছোট গোলাকৃতি স্টেনলেস স্টিলের আল্লাহ ও মোহাম্মাদ (স.) লেখা স্থাপন করা হয়েছে। গেটের উপরের অংশে সাদা টাইলসের ওপর তিন লাইনে তিন গ্রামের নাম, প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও উদ্বোধনের তারিখসহ নামফলক লাগানো হয়েছে। গেট ও মেহরাবটি অনেক দূরে থেকেই মানুষের চোখে পড়ে। চলনবিলের মাঝে এই স্থাপনাটি মানুষের নজর কেড়েছে। বর্ষাকালে এটি জৌলুস ফিরে পায়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিল দেখতে আসা দর্শনার্থীরা দূর থেকে বিলের ভিতর সুউচ্চ গেট মেহরাব আর সাদা টাইলস চকচক করতে দেখে এই ঈদগাহটি দেখতে আসেন। তাছাড়া শুধু ঈদগাহটি দেখার জন্য বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ নরসিংহপাড়া শুকলাই ও শুকলাইহাট এ তিনগ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানে আসেন। পবিত্র ঈদের নামাজ আদায় করতেও অনেকেই আসেন এখানে। ঈদে এতিনটি গ্রামের মানুষ ছাড়াও আশপাশের অনেকেই নৌকা যোগে এখানে এসে বন্যাসহায়ক ঈদগাহে নামাজ আদায় করেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে বড়পাঙ্গাসী ইউনিয়নের নরসিংহপাড়া শুকলাই ও শুকলাইহাট তিন গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানে গিয়ে দেখা গেছে, চারদিকে যতদূর চোখ যায় ফসলের মাঠ। এর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটি দ্বিতল স্থাপনা। দূর থেকে দেখে এই স্থাপনাটি আসলে কি সেটা লক্ষ্য করা না গেলেও এর সামনের গেটটি ও মেহরাব দেখলে বোঝা যায় এটি একটি ঈদগাহ। আমরা এর আগে বন্যাসহায়ক মসজিদ নির্মাণের কথা শুনছি এবং অনেক স্থানে বন্যাসহায়ক মসজিদ দেখলেও বন্যাসহায়ক ঈদগা আগে কখনো দেখা হয়নি। ধারনা করা যাচ্ছে এটি দেশের প্রথম বন্যাসহায়ক ঈদগাহ। এই বন্যাসহায়ক ঈদগাহটি ২০১৯ সালে নির্মিত হয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার বড়পাঙ্গাসী ইউনিয়নের নরসিংহপাড়া শুকলাই ও শুকলাইহাট তিন গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানে। বর্ষায় দেখতে পানিতে ভাসমান এবং গ্রীষ্মে সবুজের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে মনে হয়। আধুনিক নির্মাণশৈলী অত্যাধুনিক কারুকার্যে নির্মিত এ ঈদগাহটি সারাদেশের মানুষের কাছেই সুপরিচিত। এটি নির্মাণের পর এ এলাকার মানুষের প্রশান্তিতে পবিত্র ঈদের নামাজ আদায় করতে পারছেন। একসময় ঈদের নামাজ পড়তে না পেরে আনন্দের ঈদ বেদনায় কাটলেও এটি নির্মাণের পর থেকে এ অঞ্চলের মানুষের মনের আনন্দে পবিত্র ঈদের নামাজ আদায় করতে পারছেন। বর্ষাকালে ঈদের দিন সকালে সকলে সাধ্যমতো পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে ডিঙি নৌকা নিয়ে ঈদগাহে আসেন। সকলেই তাদের নৌকাগুলো নিচে বেঁধে ঈদগাহের দ্বিতীয়তলায় নামাজ আদায় করার জন্য দাঁড়িয়ে যান। এই অপরূপ দৃশ্যের সাক্ষী হতে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ঈদের নামাজ পড়তে এখানে আসেন। শুষ্ক মৌসুমে মুসল্লিরা দ্বিতল ঈদগাহটির উপরে এবং নিচে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন। এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজও এই ঈদগাহের নিচতলায় এবং দ্বিতলায় অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। ঈদের দুদিন আগে থেকেই ঈদগাহটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন স্থানীয়রা।
দ্বিতল ঈদগাহ মাঠ নির্মাণের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও উদ্যোক্ত সাংবাদিক, প্রকাশক সাহিত্যিক মোস্তফা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নরসিংহপাড়া, শুকলাইহাট ও শুকলাই গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানে নরসিংহপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে ১৩ বিঘা জমি। জমির পশ্চিমপাশে ছোট্ট একটি মেহরাব। এটিই এই তিন গ্রামের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ। বর্ষাকালে চারদিকে অথৈ পানি, দূর থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে মেহরাবটি দেখেই ঠাওর করা যায় যে এটি কেন্দ্রীয় ঈদগাহ। শুষ্ক মৌসুমে বিলের জমিগুলো সাধারণত এবরো-থেবরো হয়ে থাকে। ঈদগাহ মাঠটিও কোথায় উঁচু কোথায় নিচু হয়ে থাকে। সেখানে জায়নামাজে বসে নামাজ পড়া যায় না। সমানতালে পা বসিয়ে দাঁড়ানো কিংবা বসা সম্ভব হয় না। এই ভোগান্তি এই তিন গ্রামের মানুষের যুগের পর যুগ থেকেই। কোনো এক বছর আমিও ঢাকা থেকে গ্রামে যাই ঈদ উদযাপনে। সেবার গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমাদের তিন গ্রামের কেন্দ্রীয় ঈদগাহে নামাজ আদায় করতে যাই ডিঙি নৌকায়। সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের ঈদগাহ মাঠটি পানিতে ডুবে আছে, সামনে সামান্য একটু অংশ জেগে আছে তা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এটি একটি ঈদগাহ মাঠ। সেখানে গিয়ে দেখলাম তিন গ্রামের মানুষ যে যার মতো ডিঙি নৌকা কলা গাছে ভেলায় মাঠের দিকে আসছে। নামাজের সময়ের পূর্বেই অসংখ্য নৌকা সমবেত হলো। এরপর নৌকাগুলো সারিবদ্ধভাবে বেঁধে রেখে নামাজ শুরু হলো। নামাজ শেষে ইমাম এই এলাকার মানুষের এই সমস্যা থেকে মুক্তি চেয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। সেদিনই আমার মনে নাড়া দিয়ে উঠল। আমি গ্রামের মানুষের এই কষ্টে ব্যথিত হলাম। এরপর নিজে নিজে পরিকল্পনা করলাম একটি ভাসমান ঈদগাহ নির্মাণের যেখানে বর্ষা এবং শুষ্ক দুই মৌসুমেই মানুষ স্বস্তিতে নামাজ আদায় করতে পারবে। আমার পরিকল্পনার কথা গ্রামের লোকদের জানালে তারা এই পরিকল্পনা শুনেই আনন্দে আত্মহারা। গ্রামবাসী আমার পাশে দাঁড়ালো তারা ঈদগাহের জন্য কিছু জমি কিনে দিলেন। এরপর সবাইকে নিয়ে শুরু করলাম দ্বিতল ঈদগাহ মাঠ নির্মাণের কাজ। পরিচিত বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন সবার কাছে সহযোগিতা চাইলাম। সবাই আমার পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করলেন। নির্মাণ কাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজে তদারকি করেছি এবং একটি কমিটি গঠন করেছিলাম এছাড়া তিন গ্রামের মানুষ এটি দেখভাল করেছে। গ্রামের মানুষ সবরকম সহযোগিতা করেছে এই কাজে। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর শেষ হলো দ্বিতল ঈদগাহ মাঠ নির্মাণের কাজ। এটি দেশের একমাত্র ভাসমান ঈদগাহ মাঠ। চলনবিলের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছে এই স্থাপনাটি। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দুঃখ দুদর্শা মুছে দিতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।
নরসিংহপাড়া শুকলাই ও শুকলাইহাট গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানের দ্বিতল ভাসমান ঈদগাহ মাঠে গিয়ে দেখা যায় কয়েকজন কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও মাঠে কাজ করা কয়েকজন শ্রমিক ঈদগাহের নিচতলায় বসে বিশ্রাম করছেন। তারা জনকণ্ঠের প্রতিবেদককে বলেন, এই ঈদগাহ নির্মাণের ফলে আমাদের কয়েক গ্রামের মানুষের কষ্ট লাঘব হয়েছে। দেশে বিভিন্ন স্থানের মানুষ এটি দেখতে আসেন। আমরা শুনেছি এটি দেশের একমাত্র বন্যাসহায়ক ঈদগাহ। তাই এই ঈদগাহের প্রতি সবারই আগ্রহ বেশি। তিন গ্রামের মানুষের পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে নামাজ পড়তে আসেন। বিশেষ করে বর্ষাকালে ঈদগাহটি খুব সুন্দর দেখা যায়। অনেক দূর থেকে বোঝা যায় যে চলনবিলের মধ্যে একটি স্থাপনা দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ সৌন্দর্য উপভোগ করতে নামাজ আদায় করতে আসেন। ঈদের সকাল থেকে এখানে নৌকা ভিড়তে থাকে। নামাজের আগ মুহূর্তে দেখা যায় চারদিকে অসংখ্য নৌকা। এই দৃশ্য দেখেই মন ভরে যায়। নামাজ আদায় ছাড়াও এই তিন গ্রামের মানুষের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত মিটিং এখানে হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে তীব্র গরমে মাঠে কাজ করা লোকজন এখানে বিশ্রাম নিতেও আসেন।
নরসিংহপাড়ার সাবেক ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের তিন গ্রামের সীমানায় কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠটি ছিল গোলাকার। বর্ষাকালে চারদিকে পানিতে ডুবে থাকত আর ঈদগাহর সামান্য একটু জেগে থাকত। বর্ষায় নৌকাতে নামাজ আদায় হতো। নৌকায় যখন নামাজ পড়তাম, নামাজের সময় বাতাসে নৌকা স্থির থাকত না। সিজদা দেওয়ার সময় মনে হতো নৌকা ডুবে যাবে। বর্ষাকালে ঈদ আসলেই আনন্দের পরিবর্তে কষ্ট বেশি হতো। নামাজ পড়ার সমস্যার কারণে আমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ ঈদে আসত না। এছাড়া বর্ষাকালে মানুষ মারা গেলে আমাদের কষ্টের সীমা থাকত না। কোথায় জানাজা নামাজ পড়ব এ নিয়ে ভয়াবহ সমস্যায় পড়তে হতো। শুষ্ক মৌসুমেও ঈদের নামাজ আদায় করতে সমস্যা হতো। ঈদগাহ মাঠটি গোলাকার এবরো-থেবরো হওয়ায় ভালোভাবে দাঁড়ানো যেত না। সবমিলিয়ে আমাদের এই তিন গ্রামের মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি ছিল ঈদের নামাজ পড়তে। আমাদের গ্রামের মোস্তফা জাহাঙ্গীর দীর্ঘদিনের এই সমস্যা দেখে এই বন্যাসহায়ক ঈদগাহ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তিনি এই ঈদগাহ নির্মাণে অনেক পরিশ্রম করেছেন। বলতে পারি তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন। ঈদগাহ নির্মাণে আমরা এতটা খুশি হয়েছি যা বলার মতো না। এখন খুব শান্তিতে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারি।
তবে এখনো কিছুটা কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। অর্থের অভাবে আমরা কাজগুলো শেষ করতে পারছি না। ঈদগাহের দ্বিতীয় তলায় প্লাস্টার নিচে চারদিকে বাউন্ডারি ওয়াল এবং উপরে শামিয়ানার ব্যবস্থা করতে পারলে মানুষ শান্তিতে নামাজ আদায় করতে পারবে। যদি কোনো বিত্তবান ব্যক্তি আমাদের একাজে এগিয়ে আসে তবে আমরা কাজগুলো সমাধান করতে পারব।
বড়পাঙ্গাসী ইউনিয়নের নরসিংহপাড়া শুকলাই ও শুকলাইহাট বন্যাসহায়ক দ্বিতল ঈদগাহ মাঠের সভাপতি আফজাল হোসেন বলেন, বিলের মানুষের জীবনযাত্রায় অনেক সমস্যা রয়েছে। আমাদের নিয়মিত যাতায়াতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। বর্ষাকালে নৌকায় আর শুষ্ক মৌসুমে আঁকাবাঁকা আইল পথে চলতে হয়। যাতায়াত সমস্যা ছাড়া আরও যেসব সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বর্ষাকালে যখন আমাদের এই অঞ্চলের অধিকাংশ ঈদগাহ মাঠটি পানিতে তলিয়ে থাকে। এ সময় বিলের মানুষের মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করতে হয়। নরসিংহপাড়া, শুকলাই ও শুকলাইহাট গ্রামের মানুষ আমরা দীর্ঘদিন যাবত দুই ঈদে সমাবেত হয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে থাকি। আমাদের তিন গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থান নরসিংহপাড়া বটতালা নামক স্থানে আমাদের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ। বর্ষাকালে এই ঈদগাহ মাঠটি পানিতে নিমজ্জিত থাকে। যার কারণে বর্ষায় নৌকায় ঈদের নামাজ পড়তে হয়। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে ঈদগাহ মাঠটি এবরো-থেবরো হয়ে থাকে। এবরো-থেবরো মাটির উপরে দাঁড়াতে সমস্যা হয়। সব কিছু মিলে আমাদের এই তিন গ্রামের মানুষের ঈদের নামাজ পড়তে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। আমরা দীর্ঘদিন স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে একটি বন্যাসহায়ক ঈদগাহ নির্মাণের দাবি জানিয়ে এলেও কেউ তাতে কর্ণপাত করেনি। অবশেষে আমার চাচাতো ভাই সাংবাদিক মোস্তফা জাহাঙ্গীর কোনো এক ঈদের নামাজ শেষে এখানে একটি দ্বিতল ঈদগাহ নির্মাণের প্রস্তাব জানালেন। তার প্রস্তাবে আমরা একযোগে রাজি হয়ে তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিলাম।
লিখন আহমেদ, উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ