ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২১ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ছন্দ প্রবর্তন

মোখতারুল ইসলাম মিলন

প্রকাশিত: ১৬:৫৬, ২০ মার্চ ২০২৫; আপডেট: ১৭:২০, ২০ মার্চ ২০২৫

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ছন্দ প্রবর্তন

মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন ২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ সালে, যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তার অসামান্য সাহিত্যকর্ম বাংলা কাব্যজগতে এক নতুন যুগের সূচনা করে।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছন্দে যে বিপ্লব সাধন করেছেন, তা বাংলা কাব্যধারায় এক নবজাগরণের সূচনা করে। বাংলা কবিতায় গদ্যের মতো স্বাভাবিক গতির ছন্দ এবং ইউরোপীয় কাব্যরীতির সংমিশ্রণ তার এক অনন্য কৃতিত্ব। তবে এই নতুন ধারার  প্রবর্তনে তাকে যে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিল এবং তার ছন্দনৈপুণ্যের পেছনের কাহিনি অনেকের কাছেই অজানা।
মধুসূদন ছিলেন ইংরেজি ও গ্রিক-ল্যাটিন সাহিত্য অনুরাগী। তিনি মিল্টন, বায়রন ও হোমারের কাব্যগুণে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে, বাংলা ভাষায় তাদের মতো গভীরতা ও ছন্দ আনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই লক্ষ্যে বাংলা কবিতায় প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় কাব্যছন্দ অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ হলো এমন এক ছন্দ, যেখানে নির্দিষ্ট মাত্রা ও কাঠামো বজায় থাকে, কিন্তু মিলবদ্ধ থাকে না। এটি বাংলা সাহিত্যে এক বিপ্লব এনে দেয়।
মধুসূদন তার মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১) রচনার সময় বাংলা কবিতায় প্রচলিত পদ্যরীতির বাইরে গিয়ে দীর্ঘ পঙ্ক্তি ও ছন্দহীন অনুরণন ব্যবহার করেন। এটি বাংলা কাব্যে এক নতুন যুগের সূচনা করে। প্রথমদিকে অনেকে এই ছন্দকে গ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। অনেক সাহিত্যবোদ্ধা মনে করতেন, বাংলা ভাষার জন্য এটি উপযুক্ত নয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এটি স্বীকৃতি পায় এবং বাংলা কবিতায় স্থায়ী জায়গা করে নেয়।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার প্রবর্তক। সনেট মূলত ইতালীয় ও ইংরেজি কবিদের মধ্যেই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু মধুসূদন বাংলা ভাষার উপযোগী করে এটিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে আসেন। তার রচিত ‘কপোতাক্ষ নদ’ বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট। যদিও প্রথম দিকে এই ধরনের কবিতা তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি, পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্য কবিরা সনেট রচনায় উৎসাহী হন।
মাইকেল যখন বাংলা কবিতায় নতুন ছন্দ প্রয়োগ করেন, তখন তৎকালীন কবি ও পাঠক সমাজের বিরোধিতার সম্মুখীন হন। প্রথাগত পয়ার ছন্দের বাইরে গিয়ে এমন বিপ্লব সাধন করায় অনেকেই তাকে বাংলা কবিতার নিয়ম ভঙ্গকারী বলে মনে করতেন। কিন্তু তার অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা ও নিরীক্ষাধর্মী প্রয়াসের ফলে বাংলা কবিতায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা কবিতায় শুধু নতুন বিষয়বস্তু আনেননি, বরং ছন্দের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। তার প্রচলিত অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও সনেট পরবর্তী কবিদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। প্রথমে সমালোচিত হলেও, পরবর্তীতে তার ছন্দ বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। তার এই অজানা সংগ্রাম বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

×