
টাই। বাংলায় বলা হয় গলাবন্ধনী। বর্তমানে চাহিদা সম্পন্ন একটি পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। টাইয়ের চাহিদা মেটাতে উত্তরের জেলা নীলফামারীতে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি মানসম্মত টাই তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় উৎপাদিত টাই জেলার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। কারখানাগুলোতে নারী কর্মীর সংখ্যাই বেশি। এই নারীদের বাড়তি আয়ের কল্যাণে তাদের পরিবারগুলোতে ফিরেছে আর্থিক সচ্ছলতা। এমন পরিবেশবান্ধব কারখানা জেলায় আরও কর্মসংস্থান বাড়বে বলে প্রত্যাশা স্থানীয়দের।
আমরা জানি অফিস বা পার্টি বা স্কুলের শিক্ষার্থীরা যে কোনো অনুষ্ঠানে শার্টের সঙ্গে নিয়ম অনুযায়ী টাই ব্যবহার করেন। যা আনুষ্ঠানিক পোশাকে শার্টের সঙ্গে গলাবন্ধনী (টাই) ফ্যাশনে যোগ করে নতুন মাত্রা। এ কারণে সবখানেই বেড়েছে টাইয়ের ব্যবহার।
নীলফামারী সদর উপজেলার নিউ বাবুপাড়ায় মোশাররফ হোসেন প্রায় ৩০ বছর আগে এই জেলায় প্রথম টাই কারখানা গড়ে তোলেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে টাই তৈরি করা হয় তার কারখানায়। কারখানাটিতে কর্মসংস্থান হয়েছে অসংখ্য নারী শ্রমিকের। গড়ে প্রতিদিন তারা আয় করছেন ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। এতে সংসারের চাহিদা মিটিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচের পরও সঞ্চয় করছেন তারা।
নিজের পড়ালেখার খরচ চালানোর পাশাপাশি বাবার অসচ্ছল পরিবারের হাল ধরেছেন রোজিনা আক্তার। তিনি বলেন, বাড়ির পাশেই কোম্পানি হওয়ায় কাজ শুরু করি এখানে। আমাদের পরিবারের অনেক সমস্যা তাই নিজের পড়াশোনা চালানোর জন্য এখানে কাজ করছি। এখান থেকে যা টাকা পাই তা দিয়ে আমার বই-খাতা কিনি, নিজের যা যা প্রয়োজন সব কিনি। কেনার পরে বাকি টাকা আমার বাবাকে দেই। কারণ আমাদের পরিবারে ৭ জন সদস্য। আমার বাবার একার আয় দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হয় না।
আরেক নারী শ্রমিক মেরিনা বেগম বলেন, আমি এখানে আট বছর ধরে কাছ করছি, এখানকার ইনকামের টাকা সঞ্চয় করে রাখছি। সেই টাকা দিয়ে আমি আমার বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছোট একটা মেয়ে আছে যে পড়ালেখা করছে। আগে অনেক কষ্ট করে দিন যাইত। বর্তমান এই কোম্পানিতে কাজ করে আমরা অনেক ভালো আছি। বেতনের টাকা দিয়ে মেয়েকে পড়াচ্ছেন ও সংসারে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন রুবিনা বেগম। তিনি বলেন, বাড়ির পাশেই কারখানা হওয়ায় ঘরের সব কাজ কাম শেষ করে এখানে কাজ করতে পারি। আমি প্রায় ১৪ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। আগে সংসারে অনেক অভাব অনটন
ছিল। এখানে কাজ করার পর এখন আল্লাহর রহমতে সংসার ভালোই চলছে। আমার মেয়ে বর্তমানে অনার্সে পড়ছে। আমি এখানে কাজ করেই তাকে পড়াচ্ছি। এর পাশাপাশি কিছু সঞ্চয়ও করছি, বর্তমান অনেক ভালো আছি।
নীলফামারী ব্যতীত দেশের অন্য কোথাও আর টাই তৈরি হয় না বলে দাবি কারখানার মালিক মোশারফ হোসেনের। টাই তৈরিতে জেলায় সব মিলিয়ে ৮ শতাধিক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানান কারখানা মালিক। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই টাই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সর্ব প্রথম আমরা কালো টাই নিয়ে কাজ শুরু করি। বিভিন্ন আদালতের আইনজীবী আমাদের থেকে সেই টাই সংগ্রহ করত। ধীরে ধীরে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, বিভিন্ন কো¤পানি, সেনাবাহিনী থেকে তাদের মনোগ্রাম দিয়ে আমাদের কাছ থেকে টাই তৈরি করে নেয়। এভাবেই আমার এখানে কাজ শিখে ও দেখে অনেকেই ছোট ছোট কারখানা গড়ে তুলেছে। সব মিলে এখন নীলফামারীতে ৩০-৩৫টি কারখানা হয়েছে। যদি কেউ টাই নিতে চায় তাকে নীলফামারীতে আসতেই হবে, নীলফামারী ব্যতীত সারাদেশে কোথাও টাই তৈরি হয় না। বিভিন্ন শোরুম আছে যারা আমাদের থেকে অর্ডার দিয়ে তাদের মন মতো ডিজাইন দিয়ে টাই তৈরি করে নেয়।
টাই শিল্পকে বর্ধিত করার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের সঙ্গে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের আশ্বাস দেওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্সের আওতা থেকে মুক্ত থাকতে কারখানার বৈধ কাগজপত্র রাখার পরামর্শ দেন নীলফামারী জেলা বিসিক কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক নূরুল হক।
তিনি বলেন, টাই একটা ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন পণ্য। দিন দিন এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শিল্পকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে কিছু কিছু উদ্যোক্তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের যে ছোট ছোট ঋণের সুবিধা রয়েছে তারা চাইলে এসব সুবিধা নিতে পারে। তাদের ওপর ভ্যাটের যে চাপ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে তারা ততটা আওতায় আসার কথা না, তবে এর জন্য তাদের কাগজপত্র ঠিক রাখতে হবে ও আমাদের অফিসগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।