
সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া নতুন সময়ের ন্যায্যতা। সমসংখ্যক নারী যদি উন্নয়ন অভিগামিতায় পেছনে পড়ে কিংবা বিচ্ছিন্ন থাকে তা হলে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি অধরা থেকে যাবে। তাই সমসংখ্যক নারীর সামাজিক সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক বলয়ে সচেতন অংশগ্রহণ জরুরি এবং দায়বদ্ধতা। অষ্টাদশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নেই নারী শিক্ষা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চল সময়ের অনিবার্যতা। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য গগন থেকে ঘরবন্দি নারীদের জাগানোর লক্ষ্যে এই শতকের প্রাণপুরুষ বিদ্যাসাগরই প্রথম অবোধ বালিকাদের শিক্ষার জন্য জোর কদমে এগিয়ে আসেন। নিজ উদ্যোগে কয়েক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে তেমন ফলপ্রসূভাবে আগাতে না পারাও চিরস্থায়ী সংস্কারের রুদ্ধতার জাল। আমাদের বাংলাদেশে রংপুরের পায়রাবন্দ জেলায় জন্ম নেওয়া মহীয়সী বেগম রোকেয়াই অন্তঃপুরবাসী কন্যাদের জোর আওয়াজে বললেন শিক্ষাই একমাত্র উপায় যা কন্যা থেকে কিশোরী যুবতী সবাই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তিটা পাবে। নারী জাগরণের দুই আলোকবর্তিকা জীবদ্দশায় সফলতার তেমন রূপ দেখে যেতে পারেননি। নারী শিক্ষার জোয়ার নামে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্ন থেকে বিশ শতকের নতুন সময়ের নির্মল আবহে। আর পেছন ফিরে তাকাতেই হয়নি। নারী শিক্ষা শুধু অবারিতই নয় বৈচিত্রিক পেশায় সমসংখ্যকের বিরতিহীন অভিগমন দেশ এবং জাতির অপরিহার্য প্রাপ্তি। তবে পেশা হিসেবে এক সময় শিক্ষিত নারী বেছে নিতেন শিক্ষকতা কিংবা মানবসেবার মহতি কর্মযোগ চিকিৎসক হিসেবে। কিন্তু যুগের দাবি ও সময়ের দুরন্ত যাত্রাপথে ব্যবসা বাণিজ্যের দিকেও দৃষ্টি ফেরাতে নারীকে খুব বেশি সময় অপচয় করতে হয়নি। একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে উদ্যোক্তা তৈরিতে নারীর যে নবযাত্রা তা এখন অনেকটা জোয়ারের পর্যায়ের। এক সময় যা ছিল হাতে গোনা। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা বাণিজ্যকে পেশা হিসেবে নির্বাচন করা অত সহজ বিষয়ও ছিল না। লড়াই করতে হয়েছে পরিবার, আজন্ম লালিত সমাজ সংস্কারের সঙ্গে। আলাপ হচ্ছিল একজন পাট শিল্প পণ্যের নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে। নাম মর্জিনা খাতুন মেরি। তার আগে বলতে হয় দেশের অর্থকরী ফসল সোনালি আঁশ পাট শিল্পকে ব্যবসা বাণিজ্যের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনায় আনতে তাকে মোটেও ভাবতে হয়নি। সেটা অবশ্যই আবহমান বঙ্গ ললনার মাতৃভূমির প্রতি অভাবনীয় দরদ আর পরম নিবেদন তো বটেই। আদি নিবাস পাবনা জেলার সুজানগর পৌরসভাধীন মানিকদীর গ্রামে। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। মা মাতৃত্বের মহিমায় একজন সফল গৃহিণী। আমরা জানি কোনো এক সময়ের কৃতী গৃহিণীরাই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উপহার দিয়েছেন। আজও তাঁদের সেখান থেকে বিরাম-বিরতি নেই। কিছুটা রদবদল এবং পরিবর্তন তো এসেছেই যুগের দাবি আর সময়ের গতি প্রবাহে। নারী শিক্ষা বিস্তারের শতবর্ষ পার হয়ে যাওয়ায় আজ শুধু গৃহিণী মা-ই নন অনেক সুশিক্ষিত মায়েরাও সন্তান বড় করে দেশের ও জাতির জন্য উপহার সামগ্রীর মতো অকাতরে দিয়েই যাচ্ছেন। মর্জিনা খাতুন মাধ্যমিক করেন শহীদ দুলাল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সুজানগর পাবনা থেকে। আর উচ্চ মাধ্যমিক নিজাম উদ্দিন আসগর আলী মহাবিদ্যালয় সুজানগর পাবনা থেকে। তারপর উচ্চ শিক্ষার পাদপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুরন্ত অভিগমন। সেখানে কিছু বেদনা তো ছিল। নিজের শহর-গ্রামই শুধু নয়, মা-বাবা-ভাইবোনদের পেছনে ফেলে লেখাপড়ার তাগিদে অন্য আর এক শহরে পদার্পণ আনন্দ-বিষাদের অবিমিশ্র ধারা তো বটেই। ভর্তি হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করে এবার নজর দিতে হলো সম্মানের কোনো পেশা নির্বাচনে। সেখানে কারও অধীনে শুধু চাকরি নয়। বরং আপন দক্ষতা আর সক্ষমতায় নিজের মতো করে সাজানো এক ফুলের বাগান। ফুল তো নয় কারুকার্য খচিত হরেক দেশীয় পাট পণ্যের নানামাত্রিক সম্ভার। তার নিজস্ব পাট পণ্য তৈরির কারখানায় অনেকেই এখন কাজ করেন সফলতার সঙ্গে নির্মল পরিবেশে। তার আগে খণ্ডকালীন কলেজ শিক্ষকের মর্যাদায় শিক্ষার্থী পড়ানোর দায়ভার তো আনন্দযজ্ঞের আর এক নিমন্ত্রণ যেন। সুজানগর মহিলা কলেজে পিতার বড় সন্তান হিসেবে দায়-দায়িত্ব নেওয়ার চিন্তায় কিছুদিন পড়াতে হয়েছে। কোনো এক সময় মনে হলো রাজধানী ঢাকায় এসে যদি আরও বড় কিছু করা যায়। যেই ভাবা সেই কাজে নেমে পড়া। প্রথমেই কম বেতনে নিজে চলার মতো একটা কাজ জোগাড় করেন। ২-৩ বছর চাকরি করার পর সচেতন উপলব্ধিতে চেতনায় ভর করল আজন্ম লালিত সেই স্বপ্ন যা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো আপন সৃজনকল্পের কোনো বাহারি শিল্পের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া। তাই চাকরির পাশাপাশি বিসিকে প্রশিক্ষণ নিতেও দেরি হয়নি। কয়েকটি লাগাতার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা হলো। নিজ উদ্যোগে কোনো কিছু শুরু করতে গেলে ত্রুটি-বিচ্যুতি যেন বিঘ্ন হয়ে না দাঁড়ায়। ভেতরের বোধে তখনো জিইয়ে আছে দেশজ কোনো পণ্যে নিজের আগামীর ভবিষ্যৎকে তৈরি করবেন।
সবার আগে নাড়া দিয়ে উঠল দেশের সোনালি আঁশই শুধু নয় রপ্তানি শিল্পেরও অনন্য যোগসাজশে অর্থকরী ফসল তো বটে। পাবনার মেয়ে ছোট বেলা থেকে দেখে দেখে বড় হয়েছেন সেখানে প্রচুর পাট গাছের সমারোহ। শুধু তাই নয় এই পাট দিয়ে তৈরি হরেক পণ্যের বাহারি কারুকার্য নয়ন ভোলানো তো বটে। আবার যার চাহিদা বিশ^ব্যাপী সেখানে সেটাই হবে আমার দেশীয় পণ্যের বিদেশী বাজার আয়ত্বে এনে আর এক স্বপ্ন বুননের পরম বাসনা। সেটা অতি অবশ্যই ছিল শক্ত মাটির ওপর দাঁড়ানোই নয় বরং কাজের মানসম্মত উপায় হিসেবে সুচারু শিল্পের নব আঙ্গিকের কারুকার্যকে শিল্পবোধে গ্রাহকের নজর কাড়া পণ্য সম্পদে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়াও। নিজেকে যথাসম্ভব প্রশিক্ষণে মনোযোগী করে পরের বিষয় ছিল একটি ছোট্ট কারখানার নবউদ্ভাবন। সেটাই যখন বাস্তবে রূপ নিল স্বপ্ন যেন কিছুটা ধরা দিল। তৃপ্তি আর মেটে না। সঙ্গতকারণে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে আরও বেশি করে দেশজ শিল্পকে দেশ থেকে বিশ^ায়নে পৌঁছে দেওয়ার বাসনা ক্রমেই তাকে এগিয়ে দিতে থাকে। এমন সব কর্মযোগ আর শিল্প পণ্যের বাহারি রূপের নবতর সংযোজনও মর্জিনাকে আবেগ আপ্লুত করে কাজের জায়গায় দারুণভাবে প্রভাবিত করতে থাকে।
অপরাজিতা প্রতিবেদক