ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২১ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১

সুই-সুতায় জীবনের নকশা

লিখন আহমেদ

প্রকাশিত: ১৬:৪৫, ২০ মার্চ ২০২৫

সুই-সুতায় জীবনের নকশা

সরকারি-বেসরকারি চাকরি ছাড়াও বিভিন্ন স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত হয়ে আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে নিজেদের আত্মসম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করছে এদেশের নারীরা। নারীরা গৃহবন্দি না থেকে বাইরে বেরিয়ে নানা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করছেন। বর্তমান বিশ্বে কোনো কাজেই পিছিয়ে নেই নারীরা। সেই আদিম যুগের গৃহবন্দি আর এ যুগের কর্মদক্ষ নারীদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীতে এমন কোনো কর্ম নেই যেখানে নারীরা তাদের দক্ষতা দেখাচ্ছে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছে। এতে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। পুরুষদের মতো তারাও সংসারের হাল ধরছেন। নিজ কর্মে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আত্মসম্মান বৃদ্ধি করছেন। তেমনি এক নারী সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার বড়হর ইউনিয়নের বড়হর গ্রামের একজন সফল উদ্যোক্তা মুর্শিদা পারভিন নয়ন। বড়হর গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ও ওয়াজেদা বেগম দম্পতির ৩য় সন্তান তিনি। ছোট বেলা থেকেই অতি মেধাবী নয়ন। নয়নের শিক্ষা জীবন শুরু নিজ গ্রাম বড়হর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, রাজশাহীর বাগমারা একটি স্কুল থেকে এসএসসি, উল্লাপাড়া সরকারি আকবর আলী কলেজ থেকে এইচএসসি এবং সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে অনার্স পাস করেন তিনি। ছাত্র জীবন থেকেই মেয়েদের নানা রকম পোশাক তৈরিসহ কাপড়ে বাহারি নকশা ফুটিয়ে তুলতে দক্ষ সে। তবে শিক্ষকতাকে তিনি পেশা হিসেবে নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। পর পর দু’বার প্রাথমিক শিক্ষকের নিবন্ধনে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও সরকারি চাকরি মেলেনি তার ভাগ্যে। এরপর নয়ন টিউশনি শুরু করেন। অস্থায়ী পেশা টিউশনিতেও মন টেকেনি তার। ২০১৫ সালে ছাত্র জীবনের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে উল্লাপাড়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তিন মাস মেয়াদি একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় নয়নের নতুন কর্মযজ্ঞ। সরকারি চাকরির ভাবনা ও টিউশনি ছেড়ে দিয়ে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের সহযোগিতায় নিজের দক্ষতা ফুটিয়ে তুলতে মরিয়া হন। টিউশনির জমানো সামান্য কিছু টাকায় একটি সেলাই মেশিন, সুই সুতায় ফুটিয়ে তুলতে থাকেন তার নিজ দক্ষতা। ধীরে ধীরে নয়নের হাতের কাজগুলো মানুষের নজরে আসতে থাকে। এভাবে নয়ন সামনের দিকে এগোতে থাকে। দিন দিন তার কর্মপরিধি বাড়তে থাকে। পরিশ্রম আর ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নয়ন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটান। উল্লাপাড়ার কয়েক সফল উদ্যোক্তার তালিকায় নিজের নাম লিখিয়েছেন তিনি। একটি সেলাই মেশিন দিয়ে একা শুরু করলেও বর্তমানে তার বুটিক ও টেইলারিংয়ে কাজ করছে অন্তত ৩০-৩৫ জন নারী। নয়নের নির্দেশনায় নিপুণ হাতে নারীরা সুই-সুতার কারুকার্যে ফুটিয়ে তুলছেন মেয়েদের থ্রি পিস, সালোয়ার-কামিজ, বোরকা, হিজাব, নকশি কাথা, বেডশিট, সোফার কভার, শাড়ি, ব্লাউজসহ নানা সামগ্রী। বর্তমানে উল্লাপাড়ায় ত্রি-নয়ন নামে টেইলারিং ও বুটিক শোরুম করেছেন তিনি। নিজের তৈরি সামগ্রীগুলো ত্রি-নয়ন শোরুমে বিক্রি করছেন তিনি। ঈদ উপলক্ষে তার ব্যস্ততার যেন শেষ নেই। উপজেলাজুড়ে মুর্শিদা পারভিন নয়ন ত্রি-নয়ন হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছেন। ব্যবসায়ের পাশাপাশি নয়ন নারীদের নিয়ে ত্রি-নয়ন যুব সংঘ ও ত্রি-নয়ন মহিলা সংগঠন পরিচালনা করছেন তিনি। সংগঠনের মাধ্যমে নয়ন নারীদের সুপ্ত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে নানা পণ্য সামগ্রী তৈরি করছেন। এতে অনেক নারীই সচ্ছলতা ফিরে পেয়েছে। নয়ন তার কর্মদক্ষতার পুরস্কারস্বরূপ বেগম রোকেয়া দিবসে অর্থনৈতিকভাবে সফল নারী ক্যাটাগরিতে জয়িতা সংবর্ধনা, নারী দিবসের মেলায় শ্রেষ্ঠ স্টলের পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। উদ্যোক্তা মুর্শিদা পারভিন নয়ন বলেন, এই সফলতার পেছনে অনেক পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা জড়িয়ে আছে। প্রথম দিকে কেউ পাত্তা দিত না, তবুও দমে যাননি। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নীলুফা ইয়াসমিন স্যার আমাকে সব সময় পরামর্শ এবং সহযোগিতা করেছেন। এ ছাড়া যুব উন্নয়ন অফিস থেকেও পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেয়েছি। আমি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমার স্বপ্ন ছিল সফল উদ্যোক্তা হওয়া। এখন আমি কিছুটা সফল হয়েছি ভবিষতে আরও কিছু পরিকল্পনা আছে। চেষ্টা করছি নিজে সফল হতে এবং অন্য নারীদেরও উদ্যোক্তার স্বপ্ন দেখাচ্ছি। বর্তমানে আমার সঙ্গে ৩০-৩৫ জন নারী কাজ করছে। আমি দুটি সংগঠনের মাধ্যমে নারীদের হাতের কাজে প্রশিক্ষণসহ নারীদের নানা বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছি। উল্লাপাড়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, নয়ন খুবই উদ্যমী নারী। তার অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর এ কাজে একাগ্রতা তাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। নয়নকে দেখে অনেক নারীই কাজের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। আমরা নয়নের মতো অন্য নারীদেরও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি।

×