
সম্প্রতি শিশু কন্যা আছিয়ার ওপর পাশবিক নির্যাতনে বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কেঁপে ওঠে। লোমহর্ষক এমন মধ্যযুগীয় বর্বরতায় সভ্যতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার উপক্রম। ৮ বছর বয়সী ক্ষত-বিক্ষত এই অবোধ শিশু কন্যাটি শেষ অবধি মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে চিরপ্রস্থানে চলে যায়। জন্ম-মৃত্যু খোদার বিধান, তারও একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া বিদ্যমান। সুস্থ, স্বাভাবিক, মানবিক জীবনযাপনে আসা-যাওয়ার চিরস্থায়ী নিয়মের অধীন সৃষ্টি সেরা মানুষ। কিন্তু তার মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু, জবরদস্তিমূলক ব্যভিচারে ক্ষত-বিক্ষত কারোর প্রয়াণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। আছিয়ার মৃত্যু সত্যিই এক অনন্য পাশবিকতার চরম ধৃষ্টতা। গত মার্চ মাসের পাঁচ তারিখ বোনের শ^শুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে যে নির্মম নির্যাতন-নিষ্পেষণের শিকার হয় তাতে সারাদেশ বিক্ষোভ, বিদ্রোহে সোচ্চার হতেও সময় লাগেনি। তাৎক্ষণিকভাবে এমন দুর্বিষহ অত্যাচার বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়লে পুরো জাতি এই নির্মম সহিংসতায় রাস্তায় নেমে আসে। প্রতিবাদে, মিছিলে যেন পুরো দেশ ঝড়ের বেগে উন্মত্ত, আস্ফালনে ফেটে পড়ার দুরবস্থা। সভ্যতা সূর্য যখন মধ্য গগনে সেখানে বর্বরতার প্রান্তসীমায় দাঁড়ানো যেন অমানিশার চরম অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া। সমস্বরে আওয়াজ উঠছে আছিয়া মারা যায়নি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কচি, কোমল, প্রাণ, শরীর শত নির্যাতনে কি আর টিকে থাকতে পারে? পারেনি। সারাদেশকে বিমর্ষ বিষণ্নতার দিশাহারা করে নিজেই চিরশান্তি ঘুমের কোলে আশ্রয় নেয়। সমাজ, সংস্কার যাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। নিকটজনের ছায়ায় যার সুস্থির, শান্তিতে থাকার কথা তারাই যখন নৃশংস শেষ ছোবলটি হানে তাতে হুঙ্কারের আওয়াজ তো উঠবেই। জোর দাবি তোলা হচ্ছে দ্রুত বিচার ব্যবস্থার সংস্কারই নয় জঘন্য অত্যাচারী ঘাতককে এই নির্মমতার জন্য ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোও পরিস্থিতির অনিবার্যতা। যে বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষতার চরম কোপানলে পৌঁছে তার মুখ থেকেই সত্যকথনের বিষয়টি সর্বজনের কাছে পরিষ্কার হয়। শুধু কি বড় বোনের বর্ণনা? তার সঙ্গে মিশে আছে এক অবিমিশ্র, যাতনা আর চরম রোষানল, ক্ষোভ। ভাবাই যাচ্ছে না এমন দুর্বৃত্তায়ন কিভাবে সম্ভব? বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয় কন্যা শিশুর ওপর বর্বরতার মূল হোতা কিন্তু চারপাশের নিকটজনরা। অমানবিক, পাশবিক দুর্বৃত্তরা ওঁৎ পেতে থাকে কাছের কাউকে তাদের বর্বরতার শিকারে পরিণত করতে। তা হলে জানাজানির আশঙ্কা কিছুটা হলেও কমে যায়। এমন দুর্বিষহ তাণ্ডবের সপ্তাহখানেকের মধ্যে আবারও নতুন করে গণমাধ্যমের খবর হচ্ছে শিশু কন্যার ওপর মধ্যযুগীয় নির্মমতা। শুধু কি তাই-ই? এই বছরেই নাকি সারাদেশে একই বয়সের পাঁচ শিশু কন্যার ওপর দুঃসহ নিপীড়নের চিত্র গণমাধ্যমের পাতাকে ভারি করে তোলে। ভাবাই যায় না শিশুর মতো কোমল মন আর শরীরে কেউ সামান্য আঁচড় কিংবা আঁচ বসাতে পারে। সেখানে দুর্ধর্ষ পাশবিক নরপশুরা যা করে দেখায় তাতে মনে হয় না আমরা কোন্ সভ্য দেশে বসবাস করছি। বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে অভিমত আসছে এই নারকীয় ধর্ষণে নাকি আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতান্ত দুর্বল। কিন্তু তাৎক্ষণিক সহিংস ঘটনাক্রমে আদালতই ত্বরিত বেগে কিছু নির্দেশনা জারিও করে। যেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হুমকির মুখে সেখানে এমন সব নির্দেশনা নাকি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। আর বাদী কিংবা ভুক্তভোগী যদি দরিদ্র কিংবা সহায় সম্বলহীন হয় তাতে তো কথাই থাকে না। মামলা হয় না সেটাও নয় কিন্তু। বিচার ব্যবস্থা শুরু হলেও ফাঁক ফোকড়ে কত আসামি যে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যায় তাও চলমান এক অপসংস্কৃতির অপকৌশল তো বটেই। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য-উপাত্তে উঠে আসে শুধু প্রতি বছরই নয় প্রতি মাসেই নাকি এমন সহিংস দুর্বৃত্তায়ন প্রতিনিয়ত বাড়ার দৃশ্য সত্যিই অসহনীয় এক নির্মমতার ক্ষতদাগ। পাষণ্ড আসামিরা ধরা যে পড়ে না তাও নয়। তবে শাস্তির আওতা পর্যন্ত যাওয়া আরও একটি প্রচলিত অপঘাত। আইন আদালত চলাকালীন সময়েও আসামি কিভাবে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে তা কিন্তু পাদপ্রদীপের আড়ালেই থাকছেই না। পারিবারিক, সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি খাটানোই প্রচলিত নিয়মবিধির বিপরীত প্রদাহ বলে বিশিষ্টজনদের অভিমত। প্রতিবারই বলা হচ্ছে আসামি যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেয়ে সমাজের আইনি কার্যক্রমকে শক্ত আর ন্যায্যতা দেবে সেটাও কেমন যেন দূর অস্ত। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসেও গাজীপুরের শ্রীপুরে কন্যা শিশু ধর্ষণের নৃশংস ঘটনাটি গণমাধ্যমকে সাড়া জাগিয়ে দেয়। পশুবৃত্তি সহায়ক কোন অমানুষ বিশেষ দিনক্ষণ জানেই না। তোয়াক্কাও করে না। অনেকে আবার বন্যপশুর নির্মম পাশবিকতার ছবি ভিডিও করে বন্ধুদের পাঠানোর দৃশ্য ও কালো অন্ধকারময় জগতে আধুনিক প্রযুক্তির অসৎ ব্যবহার। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির জগৎ ও সমসংখ্যক নারীর জন্য নিরাপদ, নির্বিঘ্ন থাকেই না। সেখানে যেভাবে কন্যা শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের অপমান, অসম্মানে নিপীড়ন করা হয় তাও নতুন শিল্প বিকাশের বলয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর মতোই। তবে কন্যা শিশু থেকে নারীর ওপর শারীরিক নিপীড়নের জন্য পারিবারিক আবাসস্থল, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোও নিতান্ত প্রাসঙ্গিক। বস্তি এলাকায় নাকি এমন অঘটনের শিকার নারী ও শিশুরা। যা দিবালোকের মতো স্পষ্টও থাকে। সেভাবে হৈচৈও হয় না। মহিলা পরিষদ কিংবা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজরে আসলে হৈ চৈ হয় অনেক। গণমাধ্যম নড়েচড়ে বসেন। আইন আদালতও তার বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি দায়বদ্ধ হন। শেষ পর্যন্ত কোথায় গন্তব্য?