
ছবি: সংগৃহীত
হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে হাতের লেখা মানুষের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল। প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে শুরু করে বর্তমান ছাপাখানার আবিষ্কার পর্যন্ত হাতের লেখার মাধ্যমে আমরা জ্ঞান ভাগ করেছি, গল্প বলেছি এবং সংস্কৃতির ব্যাখা করেছি।
কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তির উত্থানের কারণে, বিশেষ করে জেনারেশন জেড যাকে (জেন জি) প্রজন্ম বলে, যারা ১৯৯০-এর দশকের শেষ থেকে ২০১০-এর দশকের শুরুর মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে হাতের লেখা একটি বিলুপ্তপ্রায় শিল্পে পরিণত হচ্ছে।এই প্রজন্মের মানুষগুলো প্রযুক্তি, সামাজিক মাধ্যম, এবং বৈশ্বিক পরিবর্তনের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। আগের প্রজন্মগুলোর তুলনায়, তারা অনেক বেশি প্রযুক্তি নির্ভর এবং সমাজের সাথে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।
স্টাভাঞ্জার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে এক ভয়ংকর তথ্য: জেনারেশন জেড-এর ৪০% তাদের হাতে লেখার দক্ষতা হারাচ্ছে।কারণ হিসেবে তারা তুলে ধরেছেন,স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, আর কম্পিউটার জীবনকে কেননা প্রতিটি ক্ষেত্রে জায়গা করে নেওয়ায় হাতে লেখা আজ জেন জি এর কাছে অবহেলিত।
কেন ৪০% জেনারেশন জেড হাতে লেখায় দুর্বল হচ্ছে।ডিজিটাল ডিভাইসের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার যোগাযোগের ধরন পাল্টে দিচ্ছে। স্কুল বা মিটিংয়ে হাতে নোট নেওয়ার যুগ যেন হারিয়ে গেছে। এখন, জেনারেশন জেড যেকোনো কিছু লিখতে ল্যাপটপ ও ট্যাবলেটের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে।
তবে এই কীবোর্ড ও টাচস্ক্রিন-এর ওপর নির্ভরতা মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। গবেষণায় দেখা গেছে, হাতে লেখা মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ — এটি টাইপিংয়ের তুলনায় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল সক্রিয় করে। এটি মনোযোগ, সূক্ষ্ম দক্ষতার বিকাশ ঘটায় এবং জ্ঞানগত সম্পৃক্ততা, স্মৃতিশক্তি শেখার ক্ষমতা এবং অনুধাবন শক্তি বাড়াবে।
কিন্তু জেনারেশন জেড-এর অনেকে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হাতে লেখার দক্ষতার অভাবে তাদের লেখা অসংগঠিত ও অস্পষ্টতা প্রকাশ পাচ্ছে । অনেক শিক্ষার্থী এখন হাতের লেখার মাধ্যমে যোগাযোগ করতে গিয়ে বিভ্রান্ত বোধ করে, যার ফলে তারা এমনভাবে লেখে যা পড়াই কঠিন হয়ে পড়ে।
সোশ্যাল মিডিয়া নিঃসন্দেহে জেনারেশন জেড-এর যোগাযোগের ধরনকে প্রভাবিত করেছে। টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, আর স্ন্যাপচ্যাট-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো সংক্ষিপ্ত, দ্রুত বার্তা বিনিময়-কে উৎসাহিত করছে। কিন্তু পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত শব্দ, ইমোজি এবং অনানুষ্ঠানিক ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে।
যার ফলে,জেন জি প্রজন্ম বেশি বেশি এই শর্টকাট গ্রহণ করার ফলে অর্থবহ কথোপকথন হারিয়ে ফেলছে। অতীতে, একটি হাতে লেখা চিঠি বা নোট ব্যক্তিগত স্পর্শ এবং আবেগের সংযোগ বহন করত, যা টেক্সট মেসেজে প্রতিফলিত হয় না। আজকাল, একটি দ্রুত ইমোজি বা কয়েকটি সংক্ষিপ্ত শব্দই যথেষ্ট মনে করা হয়। জেনারেশন জেড ধীরে ধীরে চিন্তাশীল বার্তা লেখার প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং এর পরিবর্তে দ্রুত পাঠ্য বিনিময়কেই প্রাধান্য দিচ্ছে।এটি কেবল হাতের লেখা হারিয়ে যাওয়ার বিষয় নয় — এটি আমাদের পরিচিত অর্থপূর্ণ যোগাযোগের পতনের সূচনা হতে পারে।
দ্রুত ইমোজি ,ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং, টুইট, আর স্ট্যাটাস আপডেট-এর উত্থান যোগাযোগ ধ্বংস করার হুমকি দিচ্ছে।সোশ্যাল মিডিয়া শুধুমাত্র অনলাইন যোগাযোগকেই প্রভাবিত করছে না, বরং এটি বাস্তব জীবনের কথোপকথনেও পরিবর্তন আনছে। আজকাল অনেক শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ বাক্য তৈরি করতে পর্যন্ত লড়াই করছে, সুসংগঠিত প্রবন্ধ লেখা তো দূরের কথা। তাদের কথোপকথন ক্রমশ সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টের মতো খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জেনারেশন জেড-এর এখনো আশা আছে যদি তারা তাদের ডিজিটাল যোগাযোগের পাশাপাশি হাতের লেখার মতো ঐতিহ্যবাহী দক্ষতার চর্চা বজায় রাখতে পারে তবেই ৫,৫০০ বছরের দক্ষতা হারাবে না ।সেই সাথে শিক্ষক, অভিভাবক এবং নীতিনির্ধারকদের উচিত তরুণদের হাতে লেখা চর্চার সুযোগ তৈরি করা ।যেমন-ডায়েরি লেখা,হাতে লেখা চিঠি পাঠানো,ক্লাস বা মিটিংয়ে হাতে নোট নেওয়া।এটি শুধু তাদের মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করবে না, বরং তাদের মনের গভীরতা প্রকাশে, এবং দ্রুত ডিজিটাল বার্তাবিনিময়ের বাইরেও অর্থপূর্ণ যোগাযোগ তৈরি করতে সাহায্য করবে।
মেহেদী হাসান