ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১

উত্তরাঞ্চলে ব্যস্ত শ্রমিক

সমতলে চা-পাতা চয়ন শুরু, চাষির মুখে চওড়া হাসি

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ১৬ মার্চ ২০২৫

সমতলে চা-পাতা চয়ন শুরু, চাষির মুখে চওড়া হাসি

.

তিন মাস বন্ধ থাকার পর নতুন মৌসুমে পা রেখেছে উত্তরাঞ্চলের সমতলের চা চাষ। সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে বাগান থেকে চলতি মৌসুমের চা-পাতা চয়ন (সংগ্রহ) কার্যক্রম। প্রুনিং, বাগানে সেচ ও পরিচর্যার জন্য তিন মাস পাতা কাটা বন্ধ ছিল। এর মাঝে বাগানগুলো পেয়েছে বৃষ্টির ছোঁয়া। ফলে বসন্ত শুরু হতেই গাছে এসেছে নতুন কুঁড়ি। যা গত দুইদিন ধরে সংগ্রহ শুরু হয়। এতে চাষিদের মুখে ফুটেছে চওড়া হাসি। কারখানাগুলোতেও শুরু হয়েছে তোড়জোড়। কাঁচা চা-পাতা সংগ্রহ ও চা উৎপাদনের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে চলতি মৌসুমে নতুন করে কাঁচা চা-পাতার দাম নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে চাষিরা ১৭ টাকা কেজি দরে কাঁচা পাতা কারখানাগুলোতে বিক্রি করছেন। ন্যায্যমূল্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরসহ ৫ জেলার হাজারো চা-চাষি।
বৃহস্পতিবার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে দেখা যায়, চাষি ও শ্রমিকরা বাগান থেকে পাতা সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বাগান থেকে চা-পাতা উত্তোলন করে বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। এখন বসন্ত। এ সময় বিভিন্ন এলাকার সমতলের চা-বাগানগুলোয় উঁকি দেয় নতুন কুঁড়ি। চা-গাছের পাতা বৃদ্ধি ও সুস্থতা এবং অধিক পাতা উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রতিবছরের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি টানা তিন মাস বাগানগুলোয় পাতা কাটা বন্ধ থাকে। এ সময় বাগানগুলোয় চলে প্রুনিং কার্যক্রম।
চাষিরা জানায়, প্রতিবছরের ১ মার্চ থেকে চা-পাতা সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয়। কিন্তু এবার দেড় সপ্তাহ পর শুরু হয়েছে।  সে মোতাবেক চাষিরাও তাদের বাগানের উৎপাদিত চা-পাতা উত্তোলন করে কারখানায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে মৌসুমে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কারখানাগুলোও চালু হয়েছে। তবে নতুন কাঁচা পাতার মূল্য নির্ধারণ না হওয়ায় ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে বেশ আতঙ্কে রয়েছেন চাষিরা। তাদের দাবি, বিগত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে সার-কীটনাশক, ডিজেল ও শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। তবে চাষিদের অভিযোগ, চা-পাতার মূল্য ওঠানামা ও পাতা বিক্রির সময় কারখানাগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে চা-পাতা কর্তন বন্ধ না করা হলে লোকসানের মুখে পড়তে হবে তাদের। অন্যদিকে চাষিরা ন্যায্যমূল্য না পাওয়া ও মূল্য ওঠানামা করায় চাপ পড়ে চা-শ্রমিকদের ওপর। এতে শ্রমিকদের মজুরিও কমে যায়। এক চা বাগানের মালিক মহসিন
মিয়া মধু বলেন, শ্রমিকদের আন্তরিকতার মধ্যে আশাতীত উৎপাদন সম্ভব। চায়ের মৌসুমের শুরুতে পরিমিত বৃষ্টিপাতে চায়ের নতুন কুঁড়ি গজাচ্ছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার ভালো উৎপাদন সম্ভব। তিনি আরও বলেন, আমরা সবচেয়ে বেশি মনোযোগী কোয়ালিটি চায়ের ওপর। আমার স্টাফদের বলেছি কোয়ালিটি চা উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য। চায়ের মান বাড়ানোর জন্য আমরা প্রুনিং করেছি। পাশাপাশি চা গাছের সর্বোচ্চ পরিচর্যা করেছি।
চা-শ্রমিক বশির বলেন, দীর্ঘ তিন মাস পর আবারও বাগান থেকে পাতা উত্তোলনের কাজ করতে পারছি আমরা। এতে আমরা অনেক আনন্দিত। তবে প্রতিবছর কাঁচা চা-পাতার দর ওঠানামা করায় চাষিদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়। তার কারণে তারা আমাদের মজুরি বৃদ্ধি করে না। ফলে আমাদের মজুরি কম দেয়। তবে পাতার দাম ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকি। একই কথা বলেন সোহরাব নামে আরেক চা-শ্রমিক। তিনি বলেন, চা-বাগানে কাজ করে যা আয় করি তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। তিন মাস কাজ বন্ধ ছিল। শীতে বাগানে তেমন কাজ ছিল না। শীতেও তেমন অন্য কাজ করতে পারিনি। কিন্তু কেউ আমাদের খবর রাখেনি।
চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানায়, উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় সমতল ভূমিতে গত মৌসুমের (২০২৩) তুলনায় এবার সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে (২০২৪) পাঁচ জেলার সমতল ভূমিতে ১ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার ১৫১ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের মৌসুমের চেয়ে ৩৫ লাখ ৫৭ হাজার কেজি কম। আর গত মৌসুমে জাতীয় উৎপাদনের ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ চা সমতল ভূমি থেকে যুক্ত হলেও এবার যুক্ত হয়েছে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
চা বোর্ডের দাবি, গত মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে অতিরিক্ত খরা, কাঁচা চা-পাতার দাম না পেয়ে চাষিরা বাগান পরিচর্যায় অনেকটা অনীহা দেখিয়েছেন এবং কিছু বাগান নষ্ট করে ফেলার কারণে উৎপাদন কিছুটা কমেছে। এ ছাড়া কারখানার মালিকদের কাঁচা পাতা ক্রয়ের সময় কর্তনকৃত কাঁচা চা-পাতা এবং উৎপাদনকৃত চায়ের সঠিক হিসাব না দেখানোর কারণেও উৎপাদনের হিসাব কম পাওয়া গেছে। সিলেট ও চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের পর দেশের উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট দেশের তৃতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। চায়ের উৎপাদনের দিক থেকে এবারও উত্তরাঞ্চল টানা চতুর্থবারের মতো দ্বিতীয় অবস্থান দখল করেছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবারের মৌসুমে সারাদেশে চায়ের উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৩০ লাখ কেজি। গত মৌসুমে সারাদেশে মোট ১০ কোটি ২৯ লাখ ১৮ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল। সেই হিসাবে এবার জাতীয়ভাবে প্রায় ১ কোটি কেজি চায়ের উৎপাদন কমেছে। উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার সমতল ভূমিতে গত মৌসুমে চা-পাতা উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৩০ কেজি। এর আগে ২০২২ সালে উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২৬ কেজি।
বাংলাদেশ চা বোর্ড আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় চায়ের বাগান গড়ে তোলে। এর পর থেকে জেলার পাঁচটি উপজেলায় ক্ষুদ্র চাষি পর্যায়ে চা চাষ ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চগড় জেলার পর ২০০৭ সালে লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয়। উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত ১০টি ও অনিবন্ধিত ২০টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে। এ ছাড়া ২ হাজার ১৭৪টি নিবন্ধিত ও ৬ হাজার ১৯৭টি অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তনের চা-বাগান (২৫ একরের কম) আছে। ২০২৩ সালে উত্তরাঞ্চলে ১২ হাজার ১৩২ দশমিক ১৮ একর জমিতে চা চাষ হলেও এবার কিছুটা কমেছে। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে ১১ হাজার ৫২৬ দশমিক ৮৭ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। এদিকে উত্তরাঞ্চলের চা চাষের পরিধি ও উৎপাদন বিবেচনায় ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ে চায়ের তৃতীয় নিলাম কেন্দ্র (অনলাইনভিত্তিক) চালু হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে এখন পর্যন্ত ৫৩টি চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা অনুমোদন নিয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড় জেলায় ২৮টি ও ঠাকুরগাঁও জেলায় একটি কারখানা চালু রয়েছে।
আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আরিফ খান জানান, এবার মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে অতিরিক্ত খরা থাকায় কাঁচা পাতা উৎপাদনে কিছুটা বাধা সৃষ্টি হয়েছিল। সেইসঙ্গে সমতলে কাঁচা চা-পাতার দাম না পেয়ে চাষিরা চা-বাগান পরিচর্যায় অনীহা থাকায় কিছু বাগান নষ্ট করে ফেলেছিলেন।
আরিফ খান বলেন, আমরা যে হিসাব পেয়েছি, এর চেয়েও চা বেশি উৎপাদন হয়েছে বলে মনে করি। কিন্তু সেটি রেকর্ডে আসেনি। কারণ, কারখানার মালিকেরা চাষিদের কাছ থেকে কাঁচা পাতা কেনার সময় যখন শতাংশ হিসাবে কর্তন করেন, সেই হিসাবটা কিন্তু রেকর্ডে থাকে না। কর্তন করা কাঁচা চা- পাতা থেকে যে চা উৎপাদিত হয়, সেটিও উৎপাদনের হিসাবে থাকে না। এসব বিষয় চায়ের উৎপাদন কম দেখানোর একটি অন্যতম কারণ।

×