
সিলেটকে বলা হয় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ। সিলেট হবিগঞ্জ মৌলভীবাজারে দেড় শতাধিক বাগানে চা-পাতা উৎপাদন হচ্ছে। এসব চায়ের বাগান ঘিরে কর্মমুখর অসংখ্য চা-কন্যা। অবিরাম চায়ের পাতা সংগ্রহ করছেন এসব চা কন্যা।
চা-কন্যাদের হাতে সংগ্রহ হওয়া পাতা ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর এগুলো মেশিনে প্রক্রিয়াজাত করে পাঠানো হয় বিক্রির জন্য ওয়্যার হাউজে। বাগানে চা-কন্যাদের শ্রমের ওপর ভর করেই দেশ অর্জন করছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। তাই চা কন্যারা হচ্ছেন দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রতীক। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বড় অবদান রয়েছে এই চা-কন্যাদের।
এ কারণে চা-কন্যাদের স্মরণীয় করে রাখতে সাতগাঁও চা-বাগানের অর্থায়নে ঢাকা-সিলেট পুরাতন মহাসড়কে হবিগঞ্জ জেলার শেষ সীমান্তে এবং মৌলভীবাজার জেলার প্রবেশদ্বারের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে চা-কন্যার ভাস্কর্য রয়েছে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এটি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির প্রকৌশলী সঞ্জিত রায়ের হাতের শৈল্পিক ছোঁয়ায় দীর্ঘ প্রায় তিন মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত এই ভাস্কর্য মন কেড়ে নিচ্ছে পথচারীদের।
প্রায় ২৪ ফুট উঁচু এই ভাস্কর্যটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নারী চা-শ্রমিকের কোমল হাতে চা-পাতা চয়নের মনোমুগ্ধকর এক নিপুণ প্রতিচ্ছবি। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর থেকে এ ভাস্কর্যটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল।
সড়কপথে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলে যেতে পাহাড় ও চা-বাগানের বুক চিরে আঁকাবাঁকা পথ ধরে বয়ে গেছে ঢাকা-সিলেট পুরাতন মহাসড়ক। হবিগঞ্জের সীমানা পেরিয়ে আসতে থাকে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল। দুই জেলার সংযোগস্থলে রয়েছে মুছাই এলাকা। পর্যটন নগরী হিসেবে খ্যাত শ্রীমঙ্গলের প্রবেশদ্বারেই অপরূপ সাজে সজ্জিত এই চা কন্যার ভাস্কর্য।
এখানে বেড়াতে আসার পথে ভাস্কর্যটি দেখে যে কেউ মনে করবেন তিনি চা-শিল্পাঞ্চলে প্রবেশ করেছেন। দেশের সব চা-শ্রমিকদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবই যেন মিলেমিশে আছে এই ভাস্কর্যটির মধ্যে। এ ভাস্কর্যের চারপাশে সবুজ চা বাগান। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এসব দেখতে দেশের নানা প্রাপ্ত থেকে পর্যটকদের পদচারণ হয় এখানে। কেউ এখানে এসে ছবি তুলেননি, এমন ব্যক্তি কমই আছেন।
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর চা বাগানের বাসিন্দা বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার বলেন, রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে শ্রমিকরা সকাল হলে ঘর থেকে বের হয়। কাজ শেষে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা। শ্রমিকদের কষ্টের জীবন।
চা বাগানে মুগ্ধ পর্যটক
জেলার নাম হবিগঞ্জ। এ জেলার নবীগঞ্জ, বাহুবল, চুনারুঘাট, মাধবপুর উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চল। এ অঞ্চলের প্রায় ১৫ হাজার ৭০৩.২৪ হেক্টর জমিতে ২৫টি ফ্যাক্টরিযুক্ত চা বাগান। আর ফাঁড়িসহ প্রায় ৪১টি বাগানের প্রায় প্রতি হেক্টর জমিতে ২২-২৫শ’ কেজি চা পাতা উৎপাদন হয়।
এখানে বাগানের চা পাতা বিক্রিতে শুধু অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে না। পরিবেশ রক্ষায় বিরাট ভূমিকা পালন করছে। বাগানগুলোকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের পদচারণ হচ্ছে। বাগানের ঢালু উঁচু টিলার সবুজ চা গাছে মন কাড়ছে পর্যটকদের। এছাড়া বাগানগুলোর টিলার নিচে রয়েছে শতাধিক ছোট বড় লেক। লেকের পানিতে ফুটছে শাপলা ফুল। পাখির বিচরণ রয়েছে। এ নান্দনিক পরিবেশে পর্যটকরা মুগ্ধ হচ্ছেন।
জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া থেকে চান্দপুর পর্যন্ত পুরাতন মহাসড়কের দুই পাশে চা বাগান। একইভাবে জেলার বাহুবলের কামাইছড়া থেকে মুছাই পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে চা বাগান আছে। বিশেষ করে সড়ক পথে যাতায়াতকারীরা সময় পেলেই চা বাগানের প্রবেশ করে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করেন। একইভাবে পর্যটকরা চা বাগানের কোনো নির্ধারিত স্থানে বসে থাকেন না, সময় সাপেক্ষে বাগানের নানা স্থান ঘুরে দেখেন।
চুনারুঘাট উপজেলার লালচান্দ বাগানে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, চারদিকে চা গাছ। মাঝখানে ছোট বড় ৬টি লেক (ঝিল)। এসব জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নিচ্ছে প্রচুর ছোট মাছ। এখানে অতিথি পাখিরা বসবাস করে লেকের কোমল পানিতে গা ভাসিয়ে বিভিন্ন পোকামাকড় ও ছোট মাছ খেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে অবস্থান করছে। পুরো দিন হাজার হাজার অতিথি পাখির কলরবে মুখরিত হচ্ছে। তাতে করে দর্শনার্থীরা মুগ্ধ হচ্ছে। কেউ যাতে তাদেরকে বিরক্ত করতে না পারে সেদিক দিয়ে বাগান কর্তৃপক্ষ খুব সজাগ।
নালুয়া চা বাগানের চারদিকে সবুজ ছায়া ঘেরা। মাঝখানে বাঞ্চারাম লেকে সাদা পদ্মফুল। লেকপাড়ে বসামাত্র প্রাণজুড়ানো বাতাস। এসবে মুগ্ধ পরিবেশ প্রেমিক জুয়েল মিয়া বলেন- এ লেকে এত সুন্দর সাদা পদ্মফুল ফোটে, পূর্বে জানা ছিল না। সবমিলিয়ে এসব অবলোকিত হয়ে আমি মুগ্ধ হলাম।
চা বাগান ঘুরতে আসা পর্যটকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, বাগানে আসার বিশেষ আকর্ষণ উঁচু নিচু টিলার সবুজ চা গাছ দেখা। বাগানের ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে গেলে তাজা চা পাতার ঘ্রাণ। সেই সঙ্গে নির্মল বাতাসে মন ভরে যায়। লেকের পানিতে শাপলা ফুল। পাখির ডাক। এসব যেন অন্যরকম অনুভূতি। যা বলে প্রকাশ করা কঠিন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) তোফাজ্জল সোহেল বলেন, জেলার চা বাগান আছে বলেই পাহাড় টিকে রয়েছে। চা গাছ মাটি ধরে রাখে। সবুজ পাতায় উৎপাদন হয় কালো দানার চা পাতা। এ পাতা দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ