
বান্দরবানে পাহাড়ের ওপর গড়ে তোলা হয়েছে আদর্শ গ্রাম মুনলাই
শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতোই সুন্দর মুনলাই গ্রাম। বান্দরবানের রুমা থেকে বগালেক যাওয়ার পথে দেখা মিলে গ্রামটির। বাংলাদেশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর গ্রাম হিসেবে ২০২৩ সালে স্বীকৃতি পায়। ছবির মতো সাজানো গোছানো গ্রামটি দিন দিন পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার পরেও বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে জেলার রুমা উপজেলার এমন সুন্দর গ্রামে পর্যটক ভ্রমণে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় গ্রামের বাসিন্দারা অভাবঅনটনের মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড়ি জেলা বান্দরবানের উঁচু নিচু পাহাড়ের টিলা আর নীল আকাশের সাদা মেঘের খেলা দেখা যায় বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন গ্রাম মুনলাইতে। জেলার রুমা উপজেলায় অবস্থিত মুনলাই পাড়াকে দেশের সুন্দরতম গ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পাহাড় নদী আর হৃদে ঘেরা এই ছিনছাম গ্রামে গেলে মনে হবে না এটি বাংলাদেশের কোনো জায়গা। এই গ্রামে যে কেউ গেলেই নৈঃসর্গিক মাধুর্যে মুহূর্তেই হারিয়ে যেতে পারে কোনো এক কল্পনার রাজ্যে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের এগারোটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বসবাসের অন্যতম পাহড়ি জেলা পার্বত্য বান্দরবানের রুমা উপজেলার সদর ইউনিয়নের মুনলাই পাড়া গ্রামের অন্যতম আকর্ষণ হলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। এখানকার রাস্তাঘাট কিংবা বাড়ির আঙিনা কোথাও কোনো ময়লা আবর্জনা পাওয়া যায় না। ছোট ছোট টিলার উপরে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বাম সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি। এই পাড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোট ৭০টি পরিবার বসবাস করে। বম সম্প্রদায়ের বাড়িগুলো কাঠের তৈরি। বাড়িগুলোতে বিলাসিতার চিহ্ন না থাকলেও ঘরের ভিতরে ও বাইরে পরিপাটি করে সাজানো থাকে। আর বাড়িগুলোর চারদিকে কেবলই সবুজের হাতছানি এবং বারান্দায় শোভা পায় অর্কিডসহ নানান জাতের ফুলের গাছ। বম জাতিরা যেমন পরিচ্ছন্ন তেমনি বাড়ির চারপাশকে পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করে রাখে। তারা একতা এবং সংঘবদ্ধতায় বিশ্বাসী। সে কারণেই তারা মিলেমিশে গ্রামটির পরিবেশ নির্মল রাখার চেষ্টা করেছেন।
স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, তাদের পাড়ায় রোজ ১০ থেকে ১৫ মিনিট করে ঘরের চারপাশ ও রাস্তা পরিষ্কার করা এই গ্রামের বাসিন্দাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। এমনকি সম্মিলিতভাবে নিয়মিত এই গ্রামের ডাস্টবিনগুলো পরিষ্কার করে গ্রামবাসীরা। তাই সেখান থেকে ছড়ায় না কোনো প্রকার দুর্গন্ধ। সমষ্টিগত প্রচেষ্টার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে নেওয়া হয়েছে উদ্যোগ। গ্রামবাসীদের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা হয়েছে মুনলাই পাড়া কমিউনিটি ট্যুরিজম দ্য ম্যানেজমেন্ট কমিটি। তাই মুনলাই পাড়া গ্রামটি কেবল সুন্দরই নয় দেশের অন্যতম সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রামের তকমাও পান। মুনলাই গ্রামটি আর দশটি পাহাড়ি জনপদ থেকে আলাদা করে তুলেছে আরও একটি বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য।
পাড়াবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাত্র ৩০ বছর আগে বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদর থেকে ৫লোদূরে বম সম্প্রদায়ের কিছু সংখ্যক মানুষ এখানে এসে আশ্রয় নেন। সেখানে তারা গড়ে তোলেন ছোট এই পাড়াটি। আর এ পাড়ানাম রাখা হয় মুনলাই পাড়া। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় শুরু থেকেই সাজানো গোছানো ছিল এই পাড়াটি। পরে বেসক্যাম্প বাংলাদেশ নামে একটি পর্যটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নেয় এখানে কমিউনিটি বেইজ পর্যটনের। নেওয়া হয় ‘মুনলাই কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম নামের উদ্যোগ। এই টুরিজ্যমের অধীনে এখানকার কয়েকটি বাড়িতে রয়েছে পর্যটকদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা। পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয়দের মনোমুগ্ধকর ঐতিহ্যবাহী বাঁশ নৃত্য উপভোগের আয়োজন। এর পাশাপাশি ট্রেকিং, ৫৫০ ফুট দীর্ঘ জিপলাইন, নদী ও খালে কায়াকিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে এ পাড়াটিতে।
মুনলাই কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বান্দরবান জেলা সদর থেকে মাত্র দুই ঘন্টায় পৌঁছানো যায় এ চমৎকার স্থানটিতে। রুমা উপজেলা সদর থেকে মাত্র তিন মিনিট কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিলে দেখা মিলবে দেশের সুন্দরতম এই গ্রামটির। জেলা শহর থেকে চাঁদের গাড়ি নিয়ে সকালে রওনা দিলে দুপুরের মধ্যে এই মুনলাই পাড়ায় পৌঁছানো যায়। মেঘে ঢাকা পাহাড়ি প্রকৃতি সাঙ্গু নদীর আর নিকটবর্তী রহস্যময় বগা লেকের সৌন্দর্য ছাড়াও পাহাড়ি টিলায় স্থানীয় বম সম্প্রদায়ের বাড়িঘর। এখানকার পাহাড়ি ইকো কটেজগুলোতে থাকতে পারলে পাহাড়ি রান্নার স্বাদও মিলে যায়। পর্যটকরা চাইলে রাতের বেলা বারবিকিউ বা ক্যাম্পায়ারের আয়োজনও করতে পারে। দুই থেকে তিন দিনের খাওয়া-দাওয়া ও হোটেল ভাড়া মিলে খরচ হতে পারে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। বান্দরবান থেকে যাওয়া আসা জনপ্রতি আরও খরচ হতে পারে হাজার চারেক টাকা।
মুনলাই পাড়ার নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া যুবতী মারিয়া বম বলেন, আমরা সবাই নিজেদের বাও বাচারপাশ সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বাড়ির আঙ্গিনাকে সুন্দর রা। দিনে দুইবার করে আমরা আমাদের ঘর ও রাস্তাঘাট পষ্কার কবলে আমাদের গ্রামটি দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
মুনলাই গ্রামের বাসিন্দা ও ‘কিছুক্ষণ রেস্টুরেন্টের’ মালিক ভান রু পুই বম বলেন, অবস্থা যেমনই হোক পাড়া সবসময় পষ্কার রাখা ছিল আমাদের নিজেদের উদ্দ্যে। আমাদের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ২০১৯ সালে এই পাড়াকে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা তিন পার্বত্য জেলায় সবচেয়ে গোছানো, সুন্দর ও পচ্ছন্ন গ্রাম উপাদিয়েলেন।
মুনলাই পাড়া কমিটির সহ-সভাপজিংসম থাং বম জানিয়েছেন, আমরা বিভিন্ন পরিস্থিতি শিকারের কারণ এবং রুমা উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমাদের পর্যটক সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসা বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে আমরা অভাব অনটনের মধ্যে দিন পার করছি।
তিনি আরও বলেন, এই গ্রামের বাসিন্দারা কখনোই তাদের বাড়ির দরজায় তালা দেয় না। কারণ গ্রামবাসীরা চুরি করা কি জিনিস তা জানেই না। যে কেউ যখন তখন ঘর খোলা রেখে বাড়ির বাইরে চলে যায়, কিন্তু ঘর থেকে কোনো জিনিস চুরি হয় না। এমনকি রাতের বেলাতেও এই গ্রামটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হলো বম সম্প্রদায়ের কেউ যখন ঘর খোলা রেখে যান তখন প্রতিবেশীরা নিজের ঘর পাহারা দিয়ে রাখে। কারণ এ সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরকে নিজের পরিবারের অংশ মনে করে। তাদের এমন ঐক্যের চেতনা এ যুগে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিরা বম বলেন, এ পাড়াটিকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন বাইরে থেকে যারা বেড়াতে আসেন তারা দেখে সন্তুষ্ট হন। শুধু পরিষ্কারই নয়, কেউ বেড়াতে এলে এখানকার তরুণ-তরুণীরা নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তাদের বরণও করেন।
এ বিষয়ে রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধরী দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, আগের তুলনায় রুমার পরিস্থিতি অনেকটা ভালো। পর্যটক আসা বন্ধ থাকার কারণে রুমা উপজেলার ব্যবসা-বাণিজ্যের খুবই খারাপ অবস্থা। যেহেতু বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে পর্যটকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা দরকার এবং আমি সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি ইউএনও হিসেবে রুমা উপজেলায় যোগদান করেই মুনলাই পাড়ায় পরিদর্শনে গিয়েছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় সাজানো গোছানো এই পাড়াটি। পাড়া আগের মতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে যতটুকু সহযোগিতা লাবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবটুকু সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি।
দৃষ্টিনন্দন মুনলাই গ্রাম
উঁচু নিচু পাহাড় এবং সাঙ্গু নদীর মধ্যে দর্শনীয় পরিবেশ আপনাকে হোম স্টে এবং রন্ধনসম্পর্কীয় অভিযান, রোমাঞ্চকর ট্রেক, কায়াকিং, দেশের দীর্ঘতম জিপ-লাইন এবং অন্যান্য অনেক অ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে বম সম্প্রদায়ের চমৎকার জীবনধারার অভিজ্ঞতা ভুলতে পারা অসম্ভব। পাহাড়ি রাস্তার দুপাশে নানা রকমের রঙিন ফুলের গাছ, ঝকঝকে ছোট্ট ঘরবাড়ি, যা স্বাভাবিকভাবেই মাচায় কয়েকটি বাড়ি রঙিন টিনের ছায়ায় এবং মেঝেও কাঠের তৈরি।
কিভাবে যাবেন মুনলাই পাড়া
বান্দরবান থেকে রুমা বাজার পর্যন্ত বাস ভাড়া ১১০ টাকা। এছাড়া রুমা বাজার থেকে মুনলাই পাড়ার দূরত্ব মাত্র ৫ লিলোমিটার। এই সড়কটি দিয়ে বগালেক ও কেওক্রাডং যাওয়া যায়। ওই পর্যটন স্পটগুলোতে যেতে চাইলে আপনি একটি চাঁদের গাড়ি (ফোর-হুইল) ভাড়া করতে পারেন (১২ জনের জন্য ৪ হাজার টাকা)। রুমা বাজার থেকে চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে ১৬ কিলোমিটার দূরে বগা লেকে যেতে পারেন। তবে কেওক্রাডং গাড়ি তেমন যায় না। এছাড়া রুমা বাজার থেকে বাইক যায়, ভাড়া ২৫০০ টাকা। তবে ভ্রমণের সময় অবশ্যই মনে রাখবেন, আপনার জন্য কোনভাবেই যেন প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি না হয়। আর স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবেন এবং কোনো ধরনের বিবাদে না জড়ানোই ভালো।
কোথায় কিভাবে থাকবেন
মুনলাই পাড়াতে হোম স্টে বেইজড ইকো কটেজ আছে। থাকা-খাওয়া সব ওখানেই করতে পারবেন। পর্যাপ্ত ওয়াশরুম ও গোসলের ব্যবস্থা আছে। তাই সেখানে ভালোভাবেই দিন কাটাতে পারবেন। এছাড়া বগালেক ও কেওক্রাডং পর্যটন স্পটেও থাকার কটেজ ও খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। দৃষ্টিনন্দন এই গ্রামে পাহাড় এবং সাঙ্গু নদীর মধ্যে দর্শনীয় পরিবেশ আপনাকে হোম স্টে এবং রন্ধনসম্পর্কীয় অভিযান, রোমাঞ্চকর ট্রেক, কায়াকিং, জিপ-লাইন এবং অন্যান্য অনেক অ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে বম সম্প্রদায়ের চমৎকার জীবনধারার অভিজ্ঞতা ভুলতে পারা অসম্ভব।
গ্রামটির উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনা
বান্দরবানে টেকসই পর্যটনকে উন্নীত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মাসে বান্দরবান পার্বত্য জেলার মুনলাই পাড়ায় বম সম্প্রদায়-ভিত্তিক পর্যটন উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ উদ্যোগে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় নেতৃত্ব দেন। এ উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল বান্দরবানের মুনলাই পাড়ায় একাধিক টেকসই পর্যটন উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা যেমন অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা, ব্যবসা/ উদ্যোক্তা উন্নয়ন, বাজার সংযোগ এবং সহযোগী ব্যবস্থাপনা। এটির লক্ষ্য প্রকৃতি সংরক্ষণ, স্থানীয় সংস্কৃতিকে সম্মান ও প্রচার করা এবং টেকসই পর্যটন বৃদ্ধি নিশ্চিত করা।
মুনলাই গ্রামটির আরও কিছু
পর্যটন তথ্য
বান্দরবানের বম সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটন শুরু হয় বেশ কয়েক বছর আগে। এ গ্রামে এখন পর্যন্ত দুটি বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে ২০-২৫ জন পর্যটক থাকতে পারে। এছাড়া ৪০জনের জন্য একটি তাঁবু রয়েছে। পাশাপাশি ট্রেকিং, ৫৫০ ফুট দীর্ঘ জিপলাইন, নদী ও খালে কায়াকিং, ট্রি ক্লাইম্বিং এবং ট্রি ক্লাইম্বিং অ্যাক্টিভিটি (ট্রি টপ অ্যাক্টিভিটি) খেলার সুবিধা রয়েছে।
মোহাম্মদ আবদুর রহিম, বান্দরবান