
ছবি : সংগৃহীত
‘প্রতিটি তর্ক আসলে যা দেখায় তা নয়’
একটি উত্তরহীন মেসেজ বা বেসিন ভর্তি বাসন-প্লেট—এক মুহূর্তে তুচ্ছ মনে হওয়া এই বিষয়গুলো হঠাৎ করে ভয়াবহ ঝগড়ায় রূপ নেয়। আপনি বিস্মিত হয়ে ভাবেন—"আমরা এখানে কীভাবে এলাম?"
সত্যটি হলো, বেশিরভাগ দ্বন্দ্ব আসলে আলোচনা করা নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে নয়। ‘৯০-১০’ নিয়ম অনুসারে, মাত্র ১০% দ্বন্দ্ব তাত্ক্ষণিক সমস্যার কারণে ঘটে, যখন বাকি ৯০% দ্বন্দ্ব চালিত হয় গভীর আবেগ—অপূর্ণ চাহিদা, অতীতের ক্ষত এবং অব্যক্ত ভয়ের মাধ্যমে। আমরা যখন শুধুমাত্র ট্রিগারের উপর মনোযোগ দিই, তখন আসল সমস্যাটি অমীমাংসিত থেকে যায় এবং একই ধরণের ঝগড়া বারবার ফিরে আসে।
‘তাহলে এই চক্র থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী?’
এটি শুরু হয় আসল সমস্যা বোঝার মাধ্যমে—যে বিষয়গুলো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে তা নয়, বরং এর পেছনের গভীর কারণগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের মাধ্যমে।
সুপারফিশিয়াল ট্রিগার বনাম আবেগগত প্রবাহ
প্রথম নজরে বেশিরভাগ দ্বন্দ্বকে মনে হয় উপরিভাগের বিষয় নিয়ে হচ্ছে—ভুলে যাওয়া কাজ, উত্তর না দেওয়া মেসেজ বা সম্পর্কের প্রতি অনীহা। এই ট্রিগারগুলো মাত্র ১০% দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এবং এর সহজ সমাধান আছে: আরও মনোযোগী হওয়া, আরও পরিকল্পনা করা এবং প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া।
তবে, প্রকৃত দ্বন্দ্ব আচরণের মধ্যে নেই—এটি আসলে সেই আচরণের গভীর অর্থ নিয়ে।
- একটি মিসড ডেট নাইট (মিস হয়ে যাওয়া ডেট) অবহেলার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।
- একটি উপেক্ষিত কথোপকথন অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ভয় তৈরি করতে পারে।
- এই আবেগগত প্রবাহ—যা দ্বন্দ্বের ৯০% অংশ জুড়ে থাকে—এটি আসলে অপূর্ণ আবেগগত চাহিদা ও সম্পর্কের অনিরাপত্তা থেকে উৎসারিত।
গভীর সমস্যার কিছু উদাহরণ:
কেউ যদি বলে, “তুমি কখনোই আমাকে শোনো না,”
আসলে সে হয়তো বলতে চাইছে—
➡️ “আমি অবহেলিত ও গুরুত্বহীন বোধ করছি। আমি এই সম্পর্কে মূল্যবান অনুভব করতে চাই।”
কেউ যদি বলে, “তুমি কেন কখনো ডেট নাইট প্ল্যান করো না?”
আসলে সে হয়তো বলতে চাইছে—
➡️ “আমি বিশেষ অনুভব করতে চাই। আমি সবসময় উদ্যোগ নিলে মনে হয় শুধু আমিই চেষ্টা করছি।”
কেউ যদি বলে, “তুমি সবসময় ফোনে থাকো যখন আমরা একসঙ্গে থাকি,”
প্রকৃত অনুভূতি হতে পারে—
➡️ “আমি অগ্রাধিকারবোধ করি না। আমি ভাবছি আমি তোমার মনোযোগের জন্য প্রতিযোগিতা করছি এবং হারছি।”
সমস্যা হলো এই গভীর ভয় ও আবেগগুলো সচরাচর সরাসরি প্রকাশ করা হয় না। বরং, দম্পতিরা কেবল ১০% সমস্যা নিয়ে তর্ক করে, কারণ তা স্বীকার করার চেয়ে গভীর আবেগ প্রকাশ করা কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এই কারণেই একই ধরনের ঝগড়া বারবার ফিরে আসে এবং হতাশা সৃষ্টি করে।
‘কিভাবে এই চক্র ভাঙবেন’
যখন আপনি বুঝবেন যে বেশিরভাগ দ্বন্দ্ব আসলে তাৎক্ষণিক সমস্যার কারণে হচ্ছে না, বরং গভীর আবেগগত চাহিদা থেকে উৎসারিত হচ্ছে, তখন আপনি সমস্যার ধরন পরিবর্তন করতে পারবেন।
১. প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগে মূল আবেগটি চিহ্নিত করুন
প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন:
✅ “এটি কি সত্যিই এই মুহূর্তের সমস্যা নাকি এটি আমার মধ্যে আরও গভীর কিছু সৃষ্টি করছে?”
উদাহরণ:
- আপনি কি সত্যিই সিংকে বাসন রাখা নিয়ে বিরক্ত, নাকি আপনি মনে করছেন যে এই সম্পর্কের ভার আপনি একাই বয়ে নিচ্ছেন?
- আপনার সঙ্গী মেসেজের উত্তর না দিলে এটি কি মেসেজ সম্পর্কে, নাকি আপনি অগ্রাধিকারবোধ করছেন না?
আসল আবেগ চিহ্নিত করলে সমস্যাটি স্পষ্ট ও বোধগম্য হয়ে যায় এবং এর কার্যকর সমাধান সম্ভব হয়।
২. অভিযোগ নয়, বরং গভীর অনুভূতি প্রকাশ করুন
❌ “তুমি কখনোই বাসনের কাজে সাহায্য করো না”
✅ “যখন আমি একা সব কাজ করি, আমি অবহেলিত এবং অদৃশ্য বোধ করি। আমি চাই যেন আমরা একসঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করি।”
❌ “তুমি আমার খেয়াল রাখো না।”
✅ “যখন আমি তোমার কাছ থেকে উত্তর পাই না, তখন আমি সংযোগহীন বোধ করি। আমরা কি আরও নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারি?”
ভুল ধরার বদলে আবেগ শেয়ার করলে সঙ্গী প্রতিরোধমূলক না হয়ে বরং গ্রহণশীল হন।
৩. বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং পুনরাবৃত্ত ধরণ শনাক্ত করুন
যদি একই ধরনের তর্ক বারবার ফিরে আসে, তাহলে গভীরে থাকা ধরণটি শনাক্ত করুন।
- যদি ঘরোয়া কাজ নিয়ে বারবার ঝগড়া হয়, তাহলে হয়তো এটি অবমূল্যায়নের অনুভূতির ইঙ্গিত।
- যদি সামাজিক পরিস্থিতির পর ঝগড়া শুরু হয়, তাহলে এটি নিরাপত্তাহীনতার ইঙ্গিত।
- যদি মেসেজ বা ফোন কল নিয়ে সমস্যা হয়, তাহলে এটি সংযোগ বিচ্ছিন্নতার ভয় নির্দেশ করে।
মূল সমস্যা চিহ্নিত করা গেলে, আপনি কেবল উপসর্গ নয়, বরং আসল কারণটির সমাধান করতে পারবেন।
৪. অনুমান নয়, বরং কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে যান
যখন ঝগড়া শুরু হয়, তখন অনুমান করার বদলে প্রশ্ন করুন:
👉 “আমরা কেন বারবার এই বিষয়ে ঝগড়া করি বলে তুমি মনে করো?”
👉 “আমরা কি এই ঝগড়ার পেছনের কারণটি নিয়ে কথা বলতে পারি?”
👉 “আমি তোমার দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে চাই—তুমি এটা নিয়ে কী অনুভব করছো?”
কৌতূহল সংযোগ তৈরি করে, অনুমান বিভাজন সৃষ্টি করে।
‘সমাধান শুরু হয় বোঝাপড়া থেকে’
অবশেষে, সম্পর্কের দ্বন্দ্ব আসলে সমস্যার কারণে নয়—এটি সমস্যার পেছনের আবেগের কারণে ঘটে। যখন আপনি অভিযোগ থেকে বোঝাপড়ায় রূপান্তর ঘটান, তখন চক্র ভাঙে এবং প্রকৃত সমাধান সম্ভব হয়।
পরবর্তীবার উত্তেজনা বেড়ে গেলে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন: “আসল বিষয়টি কী?”
কারণ সমাধানের শুরুটা সেখান থেকেই হয়।
মো. মহিউদ্দিন