ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১০ মার্চ ২০২৫, ২৬ ফাল্গুন ১৪৩১

অন্য ফসলের চেয়ে লাভ বেশি

নদী তীরবর্তী এলাকায় ভুট্টা চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে

তাহমিন হক ববী 

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ৯ মার্চ ২০২৫

নদী তীরবর্তী এলাকায় ভুট্টা চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে

উত্তরাঞ্চলের চর এলাকায় ভুট্টা আবাদ বেড়েছে

চলমান শুষ্ক মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলো এখন ফসলের ভরা মাঠে পরিণত হয়েছে। তিস্তা, বুড়ি তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, ধাইজান, নাউতারা, বুড়িখোড়া, যমুনেশ্বরী, আউলিয়াখানা, চিকলিসহ বিভিন্ন নদনদী এখন প্রায় পানিশূন্য। নদীর বুকে জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে চাষ হয়েছে বোরো, ভুট্টাসহ নানা রবিশস্য। তবে সব ছাপিয়ে গেছে ভুট্টার ফলন। 
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতি বছর রবি মৌসুমে বিস্তীর্ণ তিস্তাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর দুই পাড়ে চর জেগে ওঠে। পুরো চরজুড়েই আবাদ করা হয় ভুট্টা। বিশেষ করে তিস্তাজুড়ে সবুজ আর সবুজের সমারোহ। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে এখন রাশি রাশি রবিশস্য।
রবিবার রংপুর কৃষি অঞ্চলের তথ্য এবং স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ ৫ জেলায় অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টাতে বেশি লাভবান হওয়ায় বেড়েছে ভুট্টা চাষ। এ বছর রবি মৌসুমে ওই ৫ জেলায় লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার ৪৩ হেক্টর জমিতে। 
উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৩ লাখ ২৮ হাজার ৯৯৩ মেট্রিক টন। তবে ভুট্টা চাষ হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ২৫১ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার ২০৮ হেক্টর জমিতে বেশি ভুট্টা আবাদ হয়েছে। এতে ভুট্টা উৎপাদন হতে পারে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ মেট্রিক টন।
গত বছর (২০২৪) ভুট্টা চাষ হয়েছিল এক লাখ ১৪ হাজার ৯৮০ হেক্টর জমিতে। ২০২৩ সালে ভুট্টা চাষ হয়েছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ ভুট্টা চাষ হচ্ছে নদী তীরবর্তী গ্রাম ও চর এলাকায়। এতেই বোঝা যাচ্ছে অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টায় বেশি লাভবান হওয়ায় রংপুর অঞ্চলে বেড়েছে ভুট্টা চাষ।
কৃষকরা জানায়, সমতলে প্রতি বিঘা জমিতে ভুট্টা হয় ২৫ থেকে ৩০ মণ। চরাঞ্চলে উৎপন্ন হয় ৩৫ থেকে ৪০ মণ। প্রতি বিঘায় ভুট্টা উৎপাদনে খরচ হয় ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। প্রতি বিঘা জমির ভুট্টা বিক্রি করে কৃষক পান ৩০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা।
তিস্তার চর এলাকার কৃষক ইসমাইল হোসেন (৫০) বলেন, ‘এ বছর ১৫ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। আশা করছি, ৫৮০ থেকে ৬০০ মণ ভুট্টা পাব। গত বছর ১০ বিঘা জমিতে ৩৭২ মণ ভুট্টা পেয়েছিলাম। প্রতি মণ ১২শ টাকায় ভুট্টা বিক্রি করে পাই চার লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ টাকা। ভুট্টা উৎপাদনে খরচ হয়েছিল এক লাখ ৩০ হাজার টাকা।’ এ বছর তিনি প্রতি মণ ভুট্টা ১৩শ থেকে ১৪শ টাকায় বিক্রির আশা করছেন। এ বছর ভুট্টা কেনার জন্য কয়েকজন ব্যবসায়ী তাকে অগ্রিম টাকা দিয়েছেন।
তিস্তার কিছামত চরের কৃষক সন্তোষ কুমার রায় (৪৫) বলেন, ‘ভুট্টা বিক্রিতে সমস্যা হয় না। দামও সন্তোষজনক পাওয়া যায়। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভুট্টার ফলন ভালো হবে। গত বছরের তুলনায় এ বছর দুই বিঘার বেশি জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। গত বছর ভুট্টা চাষ করেছিলাম সাত বিঘা জমিতে।’ তিস্তার চর ঝাড়শিঙ্গেশ্বর এলাকার কৃষক আছির উদ্দিন (৬০)  বলেন, ‘ভুট্টা চাষ চরাঞ্চলে দারিদ্র্য কমিয়েছে। ভুট্টা চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছি। ভুট্টা ব্যবসায়ী ও ফিড কো¤পানির প্রতিনিধিরা সরাসরি আমাদের কাছ থেকে ভুট্টা কেনেন।’ এ বছর তিনি ৯ বিঘা জমি থেকে ৩৪৫ মণ ভুট্টার ফলন আশা করছেন।
ভুট্টা ব্যবসায়ী মোকসেদ আলী জানান, কয়েকটি ফিড কো¤পানি এ অঞ্চলে ক্রয়কেন্দ্র খুলেছে। এসব কেন্দ্রে কৃষকরা সরাসরি ভুট্টা বিক্রি করেন। আমরা কৃষকদের কাছ থেকে ভুট্টা কিনে ফিড কো¤পানিগুলোয় সরবরাহ করি, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত বছর প্রতি মণ ভুট্টা এক হাজার ১৫০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায় কিনেছিলাম। এ বছর ভুট্টার দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না।’
জানা যায়, এক দশক আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে সারাদেশে ৪ লাখ ৮৭ হাজার একর জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়েছিল বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে জানা যায়। কৃষকরা জানান, আশানুরূপ লাভ হওয়ায় ধীরে ধীরে ভুট্টা চাষে আগ্রহ বেড়েছে।
বাংলাদেশ মেইজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি মিজানুর হক বলেন, স্থানীয়দের মাঝে ভুট্টা শস্য অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ এটি তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সহায়তা করেছে। কিন্তু ভুট্টার চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও দেশীয় চাহিদার প্রায় ২০-৩০ শতাংশ এখনো আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। দেশে ক্রমবর্ধমান পোল্ট্রি ফিড এবং বেকারি কোম্পানির কারণে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি বছর প্রায় ৫৫-৬০ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদিত হচ্ছে। 
সুতরাং, আমাদের দেশের কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভুট্টা অবদান রাখছে।’
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে ভুট্টার চাষ প্রায় ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে। ভুট্টা দেশের কৃষি অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। ভুট্টা চাষে কৃষক পরিবারে সচ্ছলতা ফিরেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছর পর আমাদের ভুট্টা আমদানি করতে হবে না।’
রংপুর কৃষি অঞ্চল কার্যালয়ের উপপচিালক আফজাল হোসেন  জানান, নব্বইয়ের দশক থেকে মূলত এই অঞ্চলে ভুট্টার আবাদ শুরু হয়। 
সাধারণত বেলে-দোআঁশ মাটিতে ভুট্টা ভালো হয়। ফলে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে ভুট্টার আবাদ বাড়তে থাকে। তা ছাড়া ভুট্টা চাষে সার, সেচ ও বালাইনাশক তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ফসলের চেয়ে কম ব্যবহার করতে হয়।’ ভুট্টা চাষে চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। রংপুর অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ভুট্টা হয়  তিস্তার তীরবর্তী গ্রাম ও চরাঞ্চলে। ভুট্টা অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে।

×