ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১

সিঁধ কাটা এখন গল্পকথা, কিন্তু একসময় তা ছিল বাস্তবের থ্রিলার!

শরিফুল রোমান, মুকসুদপুর

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ২ মার্চ ২০২৫

সিঁধ কাটা এখন গল্পকথা, কিন্তু একসময় তা ছিল বাস্তবের থ্রিলার!

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলা উপন্যাস, বিভিন্ন সিনেমা কিংবা নাটকে সিঁধেল চোরের দেখা পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দীতেও সিঁধেল চোর ছিল গ্রামবাংলার আতঙ্ক। তবে এখন আর এদের দেখা পাওয়া যায় না। সিঁধেল চোর বিলুপ্ত হলেও  তাদের গল্প এখনো লোকমুখে শোনা যায়।

সিঁধেল চোররা সারা গায়ে জবজবে তেল মেখে, মুখে ভূষা লাগিয়ে, ছোট ধুতি কিংবা গামছা খুবই শক্ত করে বেঁধে খালি গায়ে বেরোত। তাদের সঙ্গে থাকত সিঁধকাঠি। সিঁধ কাঠি তৈরি হতো কামারশালায়।

গ্রামগঞ্জে একটি কথা প্রচলিত ছিল, ‘চোরে কামারে দেখা নেই, সিঁধকাঠি তৈরি আছে।’
সিঁধকাঠি দেখতে অনেকটা ছোটো শাবলের মতো। ধীরে ধীরে ইট আর মাটি সরিয়ে গর্ত করত তারা। তারপর সবার আগে পা ঢোকাত।

এ নিয়ে এক গল্প প্রচলিত আছে। সিঁধ কাটার শব্দ পেয়ে বাড়ির বউ রাম দা হাতে দাঁড়িয়ে থাকত। চোর যে-ই না মাথা ঢোকাত, দিতো এক কোপ! তাই সমূহবিপদ মাথার বদলে পা দিয়ে দূর করত সেকালের সিঁধেল চোরেরা।

আগের কালের দক্ষ চোরেরা মানুষের নিঃশ্বাসের ওঠা-পড়ায় বুঝতে পারত গৃহস্থের ঘুম কতখানি গভীর। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই দিতো এক দৌড়।

অনেক সময় পালাত জঙ্গলে। আবার গরমের দিনে অনেক সময় নামত পুকুরে। মাথায় মাটির হাঁড়ি রেখে ভেসে থাকত তারা। আবার দৌড়ে পালাতে গিয়ে চোর পানিতে পড়ে গিয়েছে এমন গল্পও শোনা যেত।

ছোট্টবেলা আশ্চর্য রকমের অবাক হয়েছিলাম যে জিনিসটা দেখে, সেটা হচ্ছে সিঁধেল চুরি। অভিনব, আয়োজনে ব্যতিক্রমী, অনন্য প্রতিভাধর মানুষটিকে চোর বলাতে অবাক হতাম। ভাবতে শুরু করলাম চোর বোধহয় আসলে খারাপ কিছু নয়। প্রচন্ড সৃজনশীল, কিন্তু সবাই তাকে কেন মারে এ নিয়ে আমার বিষ্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকলো না।

এরও আগে আমার ধারণা জন্মেছিল চোর মানে হচ্ছে এক ভিন্ন প্রানীর নাম। যার মাথায় দুটো শিং থাকে। সেই শিং দিয়ে সে মাটির ঘরে গর্ত খুঁড় ভেতরে ঢোকে এবং সব জিনিস নিয়ে যায়। পরে একবার এক চোর দেখে আমার ভুল ভেঙে গেল। সেটা ছিল ছিঁছকে চোর। সে গর্তখুড়েও ঢোকেনি। কিন্তু রাতের বেলা পাড়াপড়শী যখন তাকে ধরে মেরে গাছের সাথে বেঁধে রাখলো, তখন আমি অবাক হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, চোরটার শিংগুলো কই? বাবা আমাকে কোলে নিয়ে ভুল ভাঙান, চোরের আসলে শিং থাকে না। তারা আমাদের মতই মানুষ।

তারপরে একদিন সিঁধেল চুরি দেখলাম। নানাবাড়ী গিয়েছিলাম শীতের বাৎসরিক ভ্রমনে। ফাইভে পড়ি। মামাতো, খালাতো ভাইবোনে পুরো বাড়ি তখন সরগরম। সবাই ওই সময়ে নানাবাড়ি বেড়াতে যেতো। সব বাড়িতেই শহুরে অতিথিদের ভিড়। সিঁধেল চুরিও তখন বেড়ে যেতো। একদিন ফজরের নামাজের আগে লোকজনের হৈচৈতে ঘুম ভেঙে গেল।  জানা গেল চোর ধরা পড়েছে। পাশেই মামার বাড়ী সিঁধ কেটেছে। মেঝো মামার ঘরের পেছনের দিকের মাটির ফ্লোরে একটা বড়সড় সিঁধ। সেটা গিয়ে উঠেছে ঘরের ভেতরে। চোর সেই গর্ত দিয়ে ভেতরে ঢুকে আলমারির তালা ভেঙে জামাকাপড়, টাকাপয়সা, স্বর্নালংকার নিয়েছে। কিন্তু ঘরের কেউ টের পায়নি। তবে হতভাগ্য চোর এ তাবৎ কর্মযজ্ঞ চালাতে বোধহয় বেশী দেরী করে ফেলেছিল। ফলশ্রুতিতে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়া মুসল্লিদের সামনে পড়ে যায়। সহযোগী বিহীন একাকী চোরকে হাতেনাতে পাকড়াও করা হয়।

আমরা সেই সিঁধ দেখে মহানন্দে নেচে উঠলাম। আমার শখ হলো ঐ সিঁধ বেয়ে ঘরের মধ্যে ঢোকা। চোরের তুলনায় সাইজে অনেক ছোট হয়েও সে গর্ত বেয়ে ঘরের গভীরে প্রবেশ করা এক রোমাঞ্চকার এডভেঞ্চারের মত মনে হলো। আমি ঘরের ভেতরে ঢুকে মামাতো বোনদের সামনে পড়লাম। বড় মামাতো ভাই আমাকে ধরে মজা করে চোর চোর বলে চ্যাচাতে শুরু করলো। মামি এসে মহাধমক, চোরে জান নিয়ে গেল, আর তোরা মজা করছিস! মামির ধমকে আমরা দৌড়ে পালাই। চোর দেখতে যাই বৈঠকখানায়। নাদুশনুদুশ চোর লুঙ্গি কাঁছা দেওয়া। হাত পেছনে মুড়ে বৈঠকখানার মাঝের একটা খাম্বার সাথে বাঁধা। সমস্ত শরীরে তার মাটি লেগে থাকলেও হাত, পা আর চেহারা তেলচকচকে। পরে জেনেছিলাম, সিঁধ কেঁটে ঘরে ঢোকার আগে সিঁধেল চোরেরা নাকি সমস্ত শরীরে তেল মেখে নেয়।

সেই চোরকে পরে কি করা হয়েছিল তা আর মনে পড়ছে না। কিন্তু তার রাত্রিভর পরিশ্রমের ফসল সিঁধ দেখে আমার তার উপরে মায়া জন্মেছিল। মাঝে মাঝে স্বপ্নও দেখতাম, বড় হলে একদিন সিঁধেল চোর হবো! কিন্তু আমার বৃদ্ধিকালীন সময়ে ক্রমশ বাড়ি-ঘরগুলো কংক্রিটের হতে থাকায় দিনদিন সিঁধেল চোরের পেশা কমতে থাকলো। এ বিপুল আয়োজনের অভিনব চুরির পদ্ধতি ক্রমশ বিস্মৃত হতে থাকলো গ্রামবাংলা থেকে। অথচ বাংলায় চুরিশিল্পে সিঁধেল চুরি অনেক রূপকথাকেও হার মানায়। 

ইমরান

×