
.
ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে নিবেদিত আয়োজনটি শুরু হয়েছিল পহেলা ফেব্রুয়ারি। সেই সুবাদে রবিবার পেরিয়েছে তেইশতম দিন। বলছি, বাঙালির মননের উৎকর্ষের প্রতীক অমর একুশে বইমেলার কথা। পূর্বের ধারাবাহিকতায় দেশের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক আয়োজনের এই সময়টির রয়েছে ভিন্ন রকম আবহ। পাঠক ও লেখকের সরব উপস্থিতিতে জমে ওঠে প্রাণের মেলা। তবে এবার যেন কোথায় মিলিয়ে গেছে চিরাচরিত সেই দৃশ্যটি। কেটে গেছে বইনির্ভর উৎসবের সুরটি। হারিয়ে গেছে নির্মল আনন্দে মেতে ওঠা প্রাণের স্পন্দন। ঘটেছে ছন্দপতন। তাই মেলা শেষ হতে মাত্র পাঁচদিন বাকি থাকলেও কাক্সিক্ষত পাঠকের দেখা মিলছে না। পরিলক্ষিত হচ্ছে মেলার মাঠে আড্ডা-গল্পের সমান্তরালে তালিকা ধরে ধরে বই কেনা মানুষের অভাব। কমে গেছে নান্দনিক প্যাভিলিয়ন থেকে স্টলে স্টলে চষে বেড়ানো বইপ্রেমীদের আনাগোনা। ফলশ্রুতিতে বিগতবছরের তুলনায় অধিকাংশ প্রকাশনীর ব্যবসায় পড়েছে মন্দার ছাপ। তাই মুনাফার পরিবর্তে অনেক প্রকাশনা সংস্থার খরচ তুলে আনা কঠিন হয়ে গেছে।
পাঠকখরার কারণ হিসেবে কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাকে দায়ী করছেন প্রকাশক, লেখকসহ সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে রয়েছে নিরাপত্তাসংক্রান্ত সমস্যা। তারা বলছেন, এবার মবতন্ত্রের প্রভাবে জর্জরিত হয়েছে প্রাণের মেলা। সূচনালগ্নে ডাস্টবিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে অস্বস্তিকর পরিবেশ। এরপর তসলিমা নাসরিনের বই প্রকাশ ও বিক্রির ইস্যুতে সব্যসাচী নামের প্রকাশনা সংস্থার স্টলে হামলা ও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে অনভিপ্রেত পরিবেশ। এখানেই শেষ নয়। মেলা চলাকালে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে কবি সোহেল হাসান গালিবকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি বইপড়ুয়া প্রগতিশীল মানুষকে আরেকবার বেদনাহত করেছে। এমন নানা
উটকো ঝামেলায় পাঠকদের একটি বড় অংশ মেলায় যাওয়া থেকে বিরত থেকেছেন।
মেলায় বইয়ের বিকিকিনি প্রসঙ্গে প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম বলেন, এবার মেলায় মানুষ থাকলেও সেই তুলনায় পাঠকের সংখ্যা নগণ্য। তাই বইয়ের বিক্রিও চরম হতাশাব্যঞ্জক। মহামারি কিংবা করোনাকাল ছাড়া বই বিকিকিনির এমন মন্দা পরিস্থিতি অতীতে ঘটেনি। ফলে অধিকাংশ প্রকাশনীর লাভ তো দূরের কথা ব্যয়ভার তুলে আনাই কঠিন হবে।
এ বিষয়ে প্রকাশনা সংস্থা কথাপ্রকাশের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, পাঠকরা কম আসায় বিগতবছরের বিবেচনায় এবার বই বিক্রি পরিমাণ খুবই কম। সাধারণত মেলা শুরুতে না জমলেও শেষের দিনগুলোয় পাঠকদের সমাগমে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এবার সেটি ঘটছে না। কারণটি হচ্ছে, শুরু থেকেই মেলায় বেশকিছু অপ্রীতিকর ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে গেছে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিঘিœত হয়েছে। ফলে পাঠকের জন্য অনুকূল পরিবেশের পরিবর্তে প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে প্রকৃত গ্রন্থানুরাগীরা মেলায় আসছেন না। একইভাবে খ্যাতিমান লেখকরাও মেলায় আসছেন না। আনিসুল হক, ইমদাদুল হক মিলনের মতো জনপ্রিয় লেখকরা অনুপস্থিত রয়েছেন মেলায়। এমন বাস্তবতায় অনলাইনে যেহেতু বই কেনার সুযোগ রয়েছে তাই মেলায় এসে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছেন না পাঠককুল।
নতুন বই : বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্যানুযায়ী এদিন প্রকাশিত হয়েছে ৬৭টি নতুন বই। এর মধ্যে কথাপ্রকাশ এনেছে ফজলে রাব্বীর চলচ্চিত্রবিষয়ক গ্রন্থ ‘মৃণাল সেন : জীবন ও সিনেমা’ এবং ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর প্রবন্ধের বই ‘নানা চোখে জীবনানন্দ’। সময় এনেছে মুনতাসীর মামুনের গবেষণাগ্রন্থ ‘জীবন এক রূপকথা’। অনিন্দ্য এনেছে মোশতাক আহমেদের কল্পবিজ্ঞানের বই ‘নিলিয়া’। অক্ষর প্রকাশনী এনেছে হাসান হাফিজের গল্পগ্রন্থ ‘অদ্ভুতূড়ে ভূতের গল্প’। শৈশব প্রকাশ এনেছে জাহিদ রেজা নূরের শিশুসাহিত্য ‘সেকেন্ড নিয়ে তুলকালাম’ এবং ইমতিয়ার শামীমের শিশুসাহিত্য ‘এ গল্প ও গল্প’। ভাবনা এনেছে মনি হায়দারের গল্পগ্রন্থ ‘ফ্যান্টাসি’। পাঠক সমাবেশ এনেছে জনাথন বার্নস রচিত ও আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া অনুুদিত দর্শনের বই ‘অ্যারিস্টটলের সঙ্গে আলাপচারিতা’।
মেলামঞ্চের আয়োজন : এদিন বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা : প্রিভিলেজের দায়’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মির্জা তাসলিমা সুলতানা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শাওলী মাহবুব। সভাপতিত্ব করেন রেহনুমা আহমেদ।
প্রাবন্ধিক বলেন, ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের আমরা দেখেছি মিছিলের সম্মুখভাবে মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে তুলে স্লোগানে স্লোগানে সকল পর্যায়ে শামিল হয়েছেন। এই আন্দোলনে এমন কোনো ক্ষেত্রে ছিল না যেখানে আমরা নারীদের উপস্থিতি দেখতে পাইনি। কিন্তু আন্দোলন সফল হওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসহ নানা পর্যায়ে নারীদের অনুপস্থিতি আমাদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে। সমাজে বিদ্যমান আধিপত্যশীল পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি নারীর রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে অস্বীকার করে এবং দেশ গঠনের কাজে নারীর অংশগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে বৈষম্যহীন দেশ গড়ার আকাক্সক্ষা পূরণ হবে না।
আলোচক বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানসহ বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সকল গণ-অভ্যুত্থান একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। সেটি হলো নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। ২৪-এর অভ্যুত্থানে নারীরা অসীম সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। এই আন্দোলন নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে রেহনুমা আহমেদ বলেন, ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে নারীরা প্রচ- সাহসের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। জুলাইয়ের চেতনাকে ধারণ করেই আমরা সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য, শ্রেণিবৈষম্য ও ধর্মীয় বৈষম্য সমাধানের দিকে অগ্রসর হবো। তাহলেই আমরা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।
লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন লেখক ও গবেষক ড. সুকোমল বড়ুয়া এবং গবেষক তাহমিদাল জামি।
আজকের মেলা : আজ সোমবার বইমেলার চব্বিশতম দিন। এদিন বিকেলে বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জন্মশতবর্ষ : অমলেন্দু বিশ্বাস’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সাইদুর রহমান লিপন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন শাহমান মৈশান। সভাপতিত্ব করবেন মিলনকান্তি দে।