
শেরপুরে হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা। বিদ্যালয়গুলোতে নেই শিশুদের পড়ানোর প্রয়োজনীয় শিক্ষক
একদিকে কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘদিনের দাবি উপেক্ষিত, অন্যদিকে নিজস্ব ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ না থাকার পাশাপাশি পরিবারের চর্চা কমে যাওয়াসহ নানা কারণে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে শেরপুরের ৭টি সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি। ২০১০ সালে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর জন্য নিজস্ব ভাষায় বই প্রকাশে আইন প্রণয়ন এবং সে আইনের আলোকে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের জন্য ৬টি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় বই প্রকাশ করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল ও সাদ্রি ভাষা। সে হিসেবে শেরপুরে শুধু গারোদের ভাষার অল্পকিছু বই পাওয়া যায়। কিন্তু এসব বই পড়ানোর জন্য শিক্ষক না থাকায় বইগুলো কাজে আসছে না।
অন্যদিকে অভিজ্ঞমহল বলছে, বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহল সারাবছর নীরব থাকলেও ভাষার মাসে আশার কথা শুনালেও কিছুদিন পরেই হারিয়ে যায় সেই কথাও। তাদের মতে, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার্থে দীর্ঘদিনের দাবি এলাকায় একটি কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজস্ব পাঠ্যবই এবং পাঠদানের জন্য প্রতিটি স্কুলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। ওইসব উদ্যোগ না নেওয়া হলে বাংলা ভাষার পথ ধরে তাদের মাতৃভাষা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলাসহ জেলায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের মোট ৭টি সম্প্রদায়ের ৬২ হাজার মানুষ বসবাস করছে। এর মধ্যে গারো ৩৪ হাজার, বর্মণ ১৭ হাজার, হদি ৪ হাজার ৫শ’, কোচ ৪ হাজার, হাজং ১২শ’, ডালু ১২শ’ এবং বানাই ১শ’ জন। তবে, সরকারি হিসেবে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ২১ হাজারের কাছাকাছি। শিশু জন্মের পর মা-বাবার মুখ থেকে যে কথা বলতে শিখে সেটিই হচ্ছে মাতৃভাষা। শিশুটি জন্মের পর মা-বাবা শব্দগুলো থেকে শুরু হলেও আস্তে আস্তে শিশুটি তার মনের সকল ভাবই মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের লোকজন ব্যবহার করে থাকে ভিন্ন ধরনের ভাষা। যারা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বা আদিবাসী হিসেবেই পরিচিত। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস সবকিছুতেই ভিন্নতা রয়েছে। জন্মের পর থেকেই তারা স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখে। সেই সঙ্গে পরিচিত হয় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গেও। তবে কালের পরিক্রমায় তাদের ওই সমৃদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি এখন দিনের পরদিন হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তারা নিজেদের চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভুলতে বসেছে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি। বর্তমানে বাঙালির মতো বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিকে প্রাধান্য দিচ্ছে তারা। তাদের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক অধিবাসী স্থানভেদে নিজেদের মতো করে কথা বলে। বর্তমানে অনেকেই ভুলে যেতে বসেছে ডালু, বানাই, বর্মণ ও হদিদের মাতৃভাষা। অগত্যা তারা এখন কথা বলছে বাংলা ভাষাতেই।
তবে টিকে আছে গারো, কোচ ও হাজংদের ভাষা। এ সম্প্রদায়ের একটি অংশ শিক্ষিত হচ্ছে আধুনিক শিক্ষায়। আর অল্পকিছু স্কুলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ধরে রাখার চেষ্টা করা হলেও শিক্ষক সংকট আছে দীর্ঘদিনের। তাই ভাষা ধরে রাখতে প্রতিটি স্কুলে বইয়ের পাশাপাশি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিক্ষক নিয়োগ ও একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু দাবি থাকলেও সরকারি কোনো উদ্যোগ না থাকায় সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আর সারাবছর এ বিষয় নিয়ে কোনো কথা হয় না। যখন ফেব্রুয়ারি মাস আসে, তখন আলোচনায় আসে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের জন্য নিজস্ব ভাষায় বই প্রকাশে ২০১০ সালে আইন প্রণীত হয়। সে মোতাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের জন্য ৬টি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় বই প্রণয়ন করে। এগুলোর মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল ও সাদ্রি ভাষা।